১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ ইং | ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:১০

অভিজাত হাসপাতালে অভিযান অপরাধ গুরুতর, সাজা নামমাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক :

নকল ওষুধ পাওয়া গেছে দেশের অভিজাত দুই হাসপাতাল ইউনাইটেড এবং অ্যাপোলোতে। রোগ পরীক্ষা করা হয় যে উপাদান (রিএজেন্ট) সেটিও মেয়াদউত্তীর্ণ পাওয়া গেছে এই দুই হাসপাতালে। আবার ব্লাড ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়াই রক্ত বিক্রি করার মতো গুরুতর অপরাধে সাজা পেয়েছে আরেক অভিজাত হাসপাতাল স্কয়ার।

অভিযোগ গুরুতর। কারণ ভেজাল ওষুধ আর মেয়াদউত্তীর্ণ রিএজেন্টে রোগ পরীক্ষায় কত রোগীর মৃত্যু বা কত রোগী ভুগেছে, সেটি জানার উপায় নেই। অথচ এসব অভিযোগে হাসপাতালগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে সর্বনিম্ন দুই লক্ষ ৬৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা।

আবার অ্যাপোলোতে ভেজাল ওষুধ ও মেয়াদউত্তীর্ণ রিএজেন্ট পাওয়া গেছে দুইবার। রীতি অনুযায়ী একই অপরাধ দুইবার করলে সাজা হওয়ার কথা প্রথমবারের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু অ্যাপোলোর ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে উল্টো।

একজন চিকিৎসক বলেন, ‘নামি প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি সাধারণ সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো রিএজেন্টগুলো মেয়াদউত্তীর্ণ। এর দাম তো খুব বেশি নয়। তার মানে এটা তারা ইচ্ছা করেই করছে।’

কী স্বার্থ থাকতে পারে?-এমন প্রশ্নে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘মেয়াদউত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে পরীক্ষা করলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। তার মানে তখন হাসপাতালে রোগীকে বেশিদিন থাকতে হয় বা বেশিবার যেতে হয়। এতে ওই রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। কাজেই এটা ইচ্ছাকৃতও হতে পারে।’

চিকিৎসক আর চিকিৎসা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা, তারা এই জরিমানাকে নামমাত্র বলছেন। এসব হাসপাতালে উচ্চহারে ফি নেয়া হয়। ফলে তাদের পক্ষে এই অংকের টাকা পরিশোধ কোনো ঘটনাই হয়। এতে কার্যত কোনো সাজাই হয় না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব হাসপাতালে এক দিনের আয়ই হয়ত ২০ লাখ টাকার বেশি। ফলে এই জরিমানা পরিশোধ করলে তাদের গায়েই লাগার কথা না।

আর নামমাত্র সারার কারণে এই নামিদামি হাসপাতালগুলো রোগীর সেবায় মান নিশ্চিত করতে হয় না বলেই সমালোচকরা বলছেন। এ কারণেই প্রায় সব কটি নামিদামি হাসপাতালে প্রায়ই ভুল চিকিৎসা, নানা কৌশলে রোগী অতিরিক্ত দিন হাসপাতালে রেখে বা ভুল প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করার অভিযোগ আসে। কিন্তু এসব অভিযোগে মামলা করলেও ভুক্তভোগী কখনও বিচার পান না। কারণ, মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায় প্রভাবশালী মালিকদের কারণে। পুলিশও সেভাবে উৎসাহ দেখায় না।

২১ মার্চ রাজধানীর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ এবং রিএজেন্টের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রমাণ পায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বেলা দুপুর ১২ টা বিকাল চারটার পর্যন্ত এই অভিযানের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম হাসপাতালটিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি অ্যাপোলো হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ইউনাইটেডের মতোই একই অপরাধর প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও ভেজাল ওষুধের পাশাপাশি পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট। আর এই অপরাধে অ্যাপোলোকে জরিমানা করা হয় ইউনাইটেডের চার ভাগের একভাগ, অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ টাকা।

এরআগে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার অভিযোগে স্কয়ার হাসপাতালকে দুই লাখ ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ব্লাড ব্যাংকের লাইসেন্স নবায়ন না করা, ক্যান্টিনের খাবারের নিম্নমানসহ পাঁচটি অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায় ওই হাসপাতালে।

আবার হাসপাতালের সামর্থের তুলনায় ‘নগণ্য’ অর্থ জরিমানা করলেও মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণ নেই। ফলে তারা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

রাজধানীতে বছর তিনেক আগে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে এবং গত বছর ধানমন্ডির আরও একটি হাসপাতালে মৃত রোগী আইসিইউতে রেখে অর্থ আদায়ের মতো গুরুতর অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এই অপরাধেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জানতে চাইস্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তারা বলছেন,‘সবকিছু একদিনে ঠিক হবে না ধীরে ধীরে একটি নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। এই জরিমানা তাদের জন্য একটি বার্তা হলেও এটা তাদেরকে একটি বড় ধরনের শাস্তি নয়।’

জানতে চাইলে ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেসরকারি  হাসপাতাল ও ক্লিনিক সমূহের পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আপনারা ইউনাইটেড, অ্যাপোলো স্কয়ার হাসপাতালকে নামি-দামি হাসপাতালে মনে করেন। কিন্তু আমি সেটা করি না। আর জরিমানার পাশাপাশি আমরা তাদেরকে নোটিশও করে থাকি যে আপনারা এতদিনের মধ্যে সংশোধন হবেন। নইলে আপনার বিরুদ্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

হাসপাতালে ভেজাল ওষুধ ও মেয়াদউত্তীর্ণ রিএজেন্টের মতো গুরুতর অপরাধের শাস্তির পরিমাণ কী এতকম হওয়া উচিত- এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন আমার তো বন্দুক বাহিনী নেই, আমার অন্য কারো উপর নির্ভর করেই অভিযান পরিচালনা করতে হয়। সেখানে তাদেরও একটি মতামত থাকে। এছাড়া জরিমানা তো জরিমানাই। সেটা দুই লাখ হোক আর ২০ লাখ হোক।’

‘আজকে যে ইউনাইটেড হাসপাতালকে জরিমানা করা হয়েছে সেটা কী আগামীকাল পত্রিকায় আসবে না? এটা থেকে কী তার কোন শিক্ষা নেবে না? সব কিছু একবারে হয় না। কোন কিছুর পরিবর্তন করতে গেলেও কিছু সময় দিতে হয়।’

কিন্তু গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এলে আসলে কি হাসপাতালগুলো সংশোধন হয়? অন্তত অ্যাপোলো সংশোধনের ধারও ধারেনি।

২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালকে নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সে সময় প্রায় ১০ লাখ ওষুধ জব্দ করেছিল র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

কিন্তু চলতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারিও এই হাসপাতালে একই অপরাধ করতে দেখা গেছে। আর বিস্ময়কর হলো দ্বিতীয় দফা বেশি সাজা না দিয়ে জরিমানা করা হয়েছে আগেরবারের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। পাঁচ লাখ টাকা মাত্র। এই অভিযানে হাসপাতালের ফার্মেসিতে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ৩০ ধরনের নকল ওষুধ এবং মেয়াদউত্তীর্ণ রি এজেন্ট পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন  বলেন, ‘ইউনাইটেড, অ্যাপোলে, স্কয়ার হাসপাতালের মত প্রতিষ্ঠানকে এত কম জরিমানা করা মোটেও ঠিক নয়।’

‘কারণ তারা মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ ফি নেয় তাতে ভেজাল ওষুধ বা অনিয়ম করার সুযোগ নেই। তারা কেন চুরি করবে?’।

‘আমরা মতে যদি আইনে থাকে জরিমানার পাশাপাশি একদিনের জন্য তাদের ল্যাব বন্ধ করে দেওয়া উচিত এবং তাদের সতর্ক করা উচিৎ যে এবার এক দিনের জন্য তোমাদের ল্যাব বন্ধ করে দিলাম ভবিষ্যতে এইরকম করলে দীর্ঘদিনের জন্য তোমাদের ল্যাব বন্ধ করে দেব।’

জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম নিজেও স্বীকার করেন, অভিজাত হাসপাতালে অপরাধের তুলনায় জরিমানার পরিমাণ খুবই কম।

তাহলে কেন এই নগণ্য জরিমানা করছেন?-এমন প্রশ্নে এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আমরা যখন অভিযানে যাই তখন আমরা তাদের কী অপরাধ করেছে সেটা বিবেচ্য করেই জরিমানা করে থাকি। আমরা তো আইনের বাইরে কিছু করতে পারি না।’

‘মনে করেন অ্যাপোলো হাসপাতালে রাখা নকল ওষুধ খেয়ে একজন রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন আর তাকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হলে এতে ওই রোগীর ক্ষতিপূরণ হবে? হবে না। এক কোটি টাকা জরিমানা করলেও হবে না। কিন্তু আমাদেরকে আইনের মধ্য থেকেই সবকিছু করতে হয়।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :মার্চ ২২, ২০১৮ ১২:৩১ অপরাহ্ণ