২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:১৭

প্রযুক্তির অপব্যবহার বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সাদমানের (ছদ্মনাম) মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু পঞ্চম শ্রেণি থেকেই। একই সময়ে কম্পিউটারও ঘাঁটাঘাঁটি। প্রযুক্তি ব্যবহারের শুরুটা পরিবারের সদস্যদের অনুকরণেই। বছর না পেরুতেই প্রযুক্তি তাকে ভয়ংকরভাবে গিলে ফেলে। পড়াশুনায় অমনোযোগী সাদমান কোনোমতে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয় কলেজে। পাঁচ বছরে মোবাইল ফোনে ফেসবুক, ইউটিউব, পর্নোগ্রাফি দেখার প্রতি আসক্তি বাড়ে সাদমানের। বাবা-মায়ের চোখ ও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে ‘নতুন বন্ধুদের’ সঙ্গে আড্ডা। প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাদমানের জীবনে জায়গা করে নেয় মাদকও। এই মাদকই একসময় সাদমানকে নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, অশ্লীল ভিডিও করে তা ইন্টারনেটেও ছেড়ে দেয়। লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সেই মেয়েটি।

কেস স্টাডি-২ : ফেসবুকে কলেজ পড়ুয়া পৌলমির (ছদ্মনাম) সঙ্গে মাইমুন নামের একটি ছেলের পরিচয় হয়। টানা দুই মাস চ্যাটিংয়ের পর তাদের সম্পর্ক একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বেশ কয়েকবার দেখা-সাক্ষাতের পর দুজনের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। একপর্যায়ে তাদের সেই সম্পর্ক অবাধ মেলামেশা ও অন্তরঙ্গ হতেও বিশ্বাস জাগায়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দুজনের এমন গভীর সম্পর্কেও ফাটল দেখা দেয়। একপর্যায়ে দুজনের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের (অশ্লীল) ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানেও পৌলমি তার জীবন বিসর্জন দিয়ে ‘সম্মান’ বাঁচানোর চেষ্টা করে।

কেস স্টাডি-৩ : বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে চাকরি করতেন ফাইয়াজ এবং পুনম (ছদ্মনাম)। পাশাপাশি ডেস্কে বসে কাজ করতেন। দুপুরে নিজেদের খাবারও ভাগাভাগি করে খেতেন। সন্ধ্যায় অফিস শেষে একসঙ্গে বাসায় যেতেন। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই থাকে। তাদের এই সম্পর্ক পরকীয়ায় রূপ নিতে বেশি সময় নেয়নি। কিন্তু গভীর এই সম্পর্কেও স্বার্থের জাল প্রকাশ পায়। দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও দেখিয়ে দিনের পর দিন ফাইয়াজকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন পুনম। বিনিময়ে প্রায়ই হাতিয়ে নিতেন অর্থ। পরে অতিষ্ঠ হয়ে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান ফাইয়াজ।

দেশে প্রতিনিয়ত এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে। যা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোতে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে নারী, শিশু ও যুবসমাজকে। কারণ হিসেবে প্রযুক্তির সহজ ব্যবহারকে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা যুবসমাজকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বাড়ছে অবক্ষয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে দ্রুত সময়ে পৃথিবীর যেকোনো খবর জানা ও আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত টিভি ও ইন্টারনেটও প্রযুক্তির অবদান। প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজতর করাসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দুর্ভাগ্যবশত এটির অপব্যবহার কিশোর ও যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শুধু কি তাই? দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে প্রশ্ন ফাঁস ঘটনা। আর এই ভয়ংকর কাজটি সহজেই করে ফেলছে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাত জেগে ফেসবুক, টুইটার, ইমো, ভিগো, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার যেন এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবে নেই তো, আপনি ব্যাকডেটেড। ভিগো লাইভে তো কোনো প্রাইভেসিই নেই। আপনি কি করছেন, তা সহজেই দেখতে পারবেন যে কেউ। ভিগো লাইভে মধ্যরাত থেকে বসে অশ্লীলতার মেলা! এতদিন যা ইউটিউব দখলে রেখেছিল। এখন তা একচেটিয়া ভিগোর দখলে। নোংরামির সেই ফুটেজ একে একে অন্যসব মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ফুটেজ দিয়ে একে অন্যকে ব্ল্যাকমেইলও করছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সবচেয়ে বড় ‘অসামাজিক মাধ্যমে’ রূপ নিয়েছে। এসব মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিচরণ করে তরুণ সমাজ। তাই ঝুঁকিটাও বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার কুফলের প্রভাব সমাজে বিশৃঙ্খলতা ও অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। এভাবে চলতে থাকলে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, পিছিয়ে যাওয়া এখন অনেক কাছে চলে এসেছে।

প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনসহ কিছু মনস্তাত্ত্বিক এবং আচরণগত পরিবর্তনও লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার একটি স্কুলে মোট ৩০ জন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসরুমে বসে পর্নোগ্রাফি দেখে এরকম ২৫ জনের মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি পাওয়া যায়। অপরদিকে, ১০০ জন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ৮৬ জন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে ৭৬ জন পর্নোগ্রাফি দেখে। ফলে তাদের আসক্তির মাত্রা বেড়ে চলছে পাশাপাশি লেখাপড়ায় অমনোযোগীর সংখ্যাও লক্ষণীয়। কিছু বিকৃত রুচিহীন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, মিউজিক ভিডিও, পর্নোগ্রাফি কিশোর ও যুবকদের খারাপ কাজে উদ্দীপনা তৈরির পাশাপাশি অনুকরণে উৎসাহ দেয়। ফলে বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি যুবসমাজ বিপথগামী হওয়ার কারণ হিসেবে আমেরিকান কয়েকজন গবেষক প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করেছেন।

কারণ, প্রযুক্তির এ অপব্যবহার তাদের ব্র্যান্ড, ইমেজ, ও গ্ল্যামারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ফলে এটির অনুকরণে যুবসমাজ ভালোমন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ ও স্মার্ট করার পেছনে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, ফেসবুকসহ প্রযুক্তির আরো অনেক মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর আবার বিপরীত ভূমিকাও লক্ষ করা যায়; যা যুবসমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৬২ শতাংশ যুবসমাজ (১২-১৬ বছর) যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফিসহ আরো অন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাংলাদেশের যুবসমাজকেও অবক্ষয় ও নানাবিধ বিশৃঙ্খলাও গ্রাস করবে।

বর্তমানে পৃথিবীর ৪৪.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয়, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৬ সালের আগস্টে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সোয়া চার কোটি। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে, যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইন্টারনেট তথ্যভা-ারের প্রায় ২৫ শতাংশই পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে ইন্টারনেটে মোট ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে পাঁচ কোটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট রয়েছে। এই ভয়ংকর থাবার বিস্তার থেকে আমাদের তরুণ সমাজের মুক্তি এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে খ্যাত ওয়েবসাইটগুলো দেশের তরুণ সমাজকে অন্ধকারের দিকেই ধাবিত করছে।

অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে কিশোর, তরুণ ও যুব সমাজের বড় একটি অংশ আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সাইবার ক্রাইমে। সাইবার ক্রাইম থেকে পরবর্তীতে ঘটছে নানা ধরনের বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, নতুনত্বের প্রতি তরুণ সমাজের আসক্তি, সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাব, পরিবারের উদাসীনতা, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে জীবনযাপন, সুফল-কুফল বিচার বিবেচনা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গ দোষ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবই মূলত সাইবার ক্রাইম সংঘটনের মূল কারণ। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের গাফিলতিও এ জন্য অনেকাংশে দায়ী।

ইদানিং মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইন বা নির্দেশনা নেই। কম দামি হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া সুবিধা সম্বলিত হ্যান্ডসেট তরুণদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে। ইন্টারনাল বা এক্সটারনাল মেমোরির মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও চিত্রগুলো সংরক্ষণ ও ব্লু টুথ প্রযুক্তিতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্যের মোবাইল ফোনে। এক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী ও গৃহবধূরা।

তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক অপরাধের বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানব বলেন, আইনের প্রয়োগের চেয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো বেশি জরুরি। পরিবারের অসচেতনতাও যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব থেকেই মূলত ধ্বংসের পথে পা বাড়াচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় লাইব্রেরি ও খেলাধুলার ক্লাব স্থাপন করতে হবে। পরিবারকে সন্তানের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।

দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ

প্রকাশ :মে ২৭, ২০১৭ ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ