নিজস্ব প্রতিবেদক:
কোটা পদ্ধতি বৈষম্য নয়, বৈষম্য দূর করার হাতিয়ার বলে একটি টেলিভিশন টক শোতে বক্তারা মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তুলে আনতে হলে কোটার বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশের বর্তমান কোটা পদ্ধতিতে কিছুটা সংস্কার করা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার রাত বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্টে এক টক শোতে এই মত দেন আলোচকরা। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. ইবরাহীম এই টক শোতে অতিথি হয়ে আসেন।
গত কয়েকটি সরকারের শেষ বছরেই সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন হয়ে আসছে। একটি অংশ কোটাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আন্দোলনকারীরা এতদিন বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের নীতি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবে এই দাবি উঠার পর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রতি তারা কোটা সংস্কারের কথা বলছেন।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, পাঁচ শতাংশ আদিবাসী কোটা এবং এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা রয়েছে। সা’দত হোসাইন জানান, কোটার এই আনুপাতিক হার এত সহজ নয়। কোটার ভেতরেও কোটা তাকে। ফলে একই জেলা থেকে বেশি সংখ্যক প্রার্থীকেও নিয়োগ দেয়া যায় না।
কোটাকে বৈষম্য দূরীকরণের হাতিয়ার উল্লেখ করে সা’দত বলেন, কোটা থাকতেই হবে। পৃথিবীর সব দেশেই চাকরিতে কোটা আছে। আলোচনার সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দিন প্রশ্ন রাখেন, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে এক শতাংশেরও কম থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত।
জবাবে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. ইবরাহীম বলেন, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। একটা দেশের সংগ্রামে অবশ্যই কোটি মানুষ অংশ নেয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দশমিকের মানুষই অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ‘আমি বলব না, দেশের সবাই অস্ত্র তুলে নেবে। কিন্তু যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তাদের পরিবারকে তো কিছুটা সুবিধা দিতেই হবে।’
ইবরাহীম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু তাদের পরিবার ছিটেফোটা আসলে পায় চাকরিতে কোটার কারণেই। এখানে হাত দেয়ার সুযোগ নেই।’ খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চান, এই সুবিধা কত দিন চলবে। আগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত থাকলেও তাদের পরিবারের জন্য কতদিন দিতে হবে।
জবাবে ইসরাফিল আলম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকলেও তারা এই সুবিধা পায়নি। একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযোদ্ধারা চাকরির আবেদনপত্রে তাদের পরিচয় লিখতে পারত না। ১৯৯৬ সালের পর থেকেই এ কারণে তাদের পরিবারকে এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এরপর থেকে তারা এই সুবিধা পাচ্ছে।’
সা’দত হোসাইন বলেন, কিছু কোটার ক্ষেত্রে জাতির আবেগ জড়িত। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা চালুর প্রস্তাব আসার পর অনেকেই ভিন্ন-ভিন্ন কথা বলেছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব যখন পাস হয়, তখন কেউ বিরোধিতা করেনি। আদিবাসীরা জনসংখ্যার ১.২ শতাংশ হলেও তাদের জন্য চাকরিতে পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা কতটা যুক্তিযুক্তি-এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘আদিবাসীরা কি ১.২ শতাংশ পিছিয়ে? নাকি তারা ৮০ শতাংশ পিছিয়ে?’।
‘যতদিন না তারা উঠে আসতে পারবে, তত দিন তাদেরকে কোটার সুবিধা দিতে হবে।’ আদিবাসীরা জনগোষ্ঠীর ১.২ শতাংশ বলে সরকারি হিসাবও জানতে নারাজ মেসবাহ কামাল। বলেন, তাদের গবেষণা অনুযায়ী দেশের তিন শতাংশ মানুষ আদিবাসী। কিন্তু আদমশুমারিতে ত্রুটির কারণে এই বিষয়টি উঠে আসে না।
আদিবাসী কোটায় দেড় শতাংশও কখনও পূরণ হয় না- এমন মন্তব্যে মেসবাহ কামাল বলেন, ‘দেশে ২৭টি জাতিগোষ্ঠী এই কোটায় আবেদন করতে পারে। কিন্তু আদিবাসী গোষ্ঠী আছে ৯৫টি। তারা আবেদনই করতে পারে না সরকার তাদের স্বীকৃতি না দেয়া। এটি একটি ত্রুটি।’
কোটার পদ শূন্য থাকছে-কিন্তু এতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না-এই বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মেসবাহ কামাল বলেন, ‘যদি এই শূন্য পদে অন্যদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে কোটার সুবিধা আর কেউ পাবে না।’
সরকারি নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা থেকে আসার বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সা’দত হোসাইন বলেন, ‘কোটাও থাকতে হবে। আবার মেধাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এখন জেলা কোটা তুলে দেয়া যায়। এখন চুয়াডাঙ্গাই কি আর ঝিনাইদহই কি? এই কোটা তুলে দিলেই তো মেধায় ৫৪ শতাংশ আর কোটায় ৪৬ শতাংশ হয়ে যায়।’
কোটার কারণে ২২৬ নম্বরে থাকা চাকরি প্রত্যাশী বাদ পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সাত হাজারতম ব্যক্তি নিয়োগ পেতে পারে-এতে প্রশাসনে সমস্যা তৈরি হয় কি না-এমন প্রশ্নে সা’দত বলেন, এটা একস্ট্রিম বক্তব্য। এমনটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়োগই হয় দুই থেকে আড়াই হাজার। সেখানে সাত হাজার তম লোক কোত্থেকে আসবে?
কোটার কারণে প্রশাসন মেধাহীন হচ্ছে- এমন যুক্তি খণ্ডন করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। তিনি বলেন, ‘অযোগ্য কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়? প্রিলিমিনানি পরীক্ষায় পাঁচ লাখ থেকে বাদ দিয়ে ১০ বা ১২ হাজারকে বাছাই করা হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষা আছে, ভাইভাও আছে। সব শেষে নির্বাচিতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ এরা সবাই যোগ্য। তাহলে অযোগ্যদের চাকরি পাওয়ার কথা কোত্থেকে উঠছে?’
সরকারের কোটা সংস্কারে কোনো আগ্রহ আছে কি না, এমন প্রশ্নে ইসরাফিল আলম বলেন, দেশের সব শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়েই উন্নয়ন করতে হবে। সরকার ১৫ জনকে নিয়ে এগিয়ে যাবে আর পাঁচ জন পিছে পড়ে থাকবে-এটা নয়। ওই পাঁচ জনকেও বিশেষ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেবে সরকার। জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুসারেই কাজ করবে সরকার।
একই প্রশ্নে সা’দত হোসাইন বলেন, কতটুকু সংস্কার হবে সেটা বলা কঠিন। কারণ একটি বিশেষ কোটার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আবেগ জড়িত। আবার নারী কোটাও থাকতে হবে। আদিবাসীরাও পিছিয়ে। প্রতিবন্ধীদেরকেও বাদ দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে জেলা কোটা বাদ দেয়াকেই তিনি সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
তবে নির্বাচনের বছরে কোটা পদ্ধতিতে সংস্কারের কোনো সুযোগ দেখছেন না বিএনপির শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. ইবরাহীম। তিনি বলেন, কী সংস্কার প্রয়োজন, কতটুকু সংস্কার প্রয়োজন সেটা নিয়ে ২০১৯ সালে আলোচনা করা যেতে পারে। টক শোতে জানানো হয়, বিশ্বের সব দেশেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পদ্ধতি চালু আছে। তবে ভারতের কোটা পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি সিস্টেমেটিক।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ