২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৫৩

বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য: আসিফ নজরুল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন বিচারিক আদালতে দণ্ড পাওয়া বেগম খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে আপিল চলাকালে জামিন পাওয়ার যোগ্য। উচ্চ আদালত জামিনের আদেশ দিনে বিচারিক আদালতের নথি দেখার যে কথা বলেছে, সেটা রীতিবিরুদ্ধ বলেও মনে করেন তিনি।

বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্ট এর টক শোতে এই মত দেন আইন বিভাগের এই শিক্ষক। রবিবার রাতে এই টক শো হয়। যা সঞ্চলনায় ছিলেন খালেদ মুহীউদ্দিন।

আসিফ নজরুল বলেন, আদালতের উপর অনেক চাপ আছে। জামিন না পেলে বিএনপি মনে করবে উনি ন্যায়বিচার পাননি। আবার ছাড়া না পেলে আওয়ামী লীগ মনে করবে ন্যায়বিচার। এই অবস্থায় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।

আদালতের রায়ের সমালোচনা করাই যেতে পারে বলে মনে করেন আসিফ নজরুল। বলেন, ‘জজ তো কথা বলতে পারেন না। কথা বলে জাজমেন্ট। জাজমেন্টের সমালোচনা সারা পৃথিবীতেই হয়।’

আসিফ নজরুল ছাড়াও এই আলোচনায় অতিথি ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহণ করা হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। সেদিনই মামলার নথি ১৫ দিনের মধ্যে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আপিল গ্রহণকারী হাইকোর্ট বেঞ্চ।

তিনদিন পর একই বেঞ্চে খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানি হয়। এ সময় দুই বিচারক আদেশ না দিয়ে নথি দেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান। এই শুনানিতে খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করে দুদক।

দুদক কেন জামিনের বিরোধিতা করছে- জানতে চান টক শোর সঞ্চালক।

জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম বলেন, ‘নিম্ন আদালত যখন একটি মামলার তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একটা মামলার রায় দেয় এবং পরে এ মামলাটি আপিলের জন্য উচ্চ আদালতে আসলে আমরা জামিনের বিরোধিতা করি। একইভাবে আমরা বিরোধিতা করেছিলাম সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ক্ষেত্রেও। আপিলের জামিনের ক্ষেত্রে মহামান্য আদালত দেখেন যে, আসামির সাজা হলো কতদিন, অন্যদিকে তিনি সাজা ভোগ করছেন কতদিন। আমি দেখিয়েছি রায়ের আগে ও পরে ২ মাস ৫ দিন সাজা ভোগ করেছেন। আগে ছিল ১ মাস ১৭ দিন। এখন ১৭ দিন।  আসামিপক্ষের দাবি ছিল, ৫ বছরের সাজা হলে এমনিতেই জামিন পায়। কিন্তু আদালতের কাছে আমাদের দাবি ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে পজেটিভ প্রমাণ আছে যা ডকুমেন্টস ও গ্রেভিটি অব এভিডেন্টস ও আছে।’

‘মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মামলা যখন আপিলে আসলো, তখন ২৬ কি ২৭টি মামলা পুনঃশুনানিতে আসলো যা ১/১১ সময়ের মামলা। এ মামলাগুলো হাইকোর্ট ডিভিশন নোটিশের উপর একোডাইল দিয়েছে। মামলাগুলোতে দুদক আপিলে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। এখন শুনানি চলছে। গত ছয় সাত বছরের বেঞ্চ সংকটের কারণে শুধু তিনটা মামলার আপিল করতে পেরেছি।’

খুরশিদ আলম বলেন, ‘খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিরুদ্ধে অরফানেজের মামলা হলো। আমি যদি এ মামলা শেষ করতে না পারি তাহলে জনগণ ভাববে আমরা এ মামলাগুলো চালাতে পারি না।’

‘গত দুই তিন বছরে আমরা বেসিক ব্যাংকের মামলার চার্জশিট দিতে পারছি না। এখন হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিচ্ছেন, তুমি বসে বসে কী করো? বাচ্চুর (আবদুল হাই বাচ্চু) বিরুদ্ধে অভিযোগের কি পাওয়া গেছে? বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর নাম এসেছে। তোমরা দ্রুত তদন্ত তাঁর চার্জশিট দাও। দুর্নীতি মামলা দ্রুত চললেও দোষ, ধীরে হলেও দোষ। আমরা কোন দিকে যাব?’।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘জামিন পাওয়া নাগরিকের অধিকার বলে আমরা মনে করি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মতেও, চুড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামিন পাওয়া নাগরিকদের অধিকার। আমাদের দেশেও একই আইন রয়েছে। তবে বড় অপরাধের কারণে জামিন হবে কি না সেটা সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। অন্যদিকে সিআরপিসির ৪৯৭ ধারায় আছে তিন ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে জামিন দেয়াটা অগ্রাধিকার বলে বিবেচনা করা হবে। সেগুলো হলো- নারী, শারীরিকভাবে অক্ষম, আর কম বয়স্ক। এর তিনি একজন বয়স্ক মহিলা। এছাড়াও অনেক কেস, ল আছে যেখানে সামাজিক মর্যাদাও বিবেচনা করা হয়।’

‘জামিন না দেয়া ক্ষেত্রে আদালত তিনটা বিষয় বিবেচনা করে তা হলো- আসামি পালিয়ে যাবেন কি না, যা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব। দ্বিতীয়টা হলো, আসামি ওই অপরাধ আবার করতে পারেন কি না। এখন তো তাঁর সেই ক্ষমতাই নেই। সর্বশেষ তিনি কি মামলার আলামত নষ্ট করতে পারেন কি না, যাও এখন সম্ভব নয়। আইনের শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়ার যোগ্য।’

দুদকের বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে আপনি যদি দলটির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্ত থাকেন এবং আওয়ামী লীগের অনুগ্রহপ্রাপ্তদের প্রতি দুর্বল থাকেন তাহলে আপনাদের (দুদকের) সমলোচনা হবে। যদি দুই পক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা আপনারা সমানভাবে লড়ছেন তাহলে আপনাদের সমালোচনা হতো না।

‘সরকারের লোকদের বিরুদ্ধে সোনালী, জনতা ব্যাংক, শেয়ারবাজার কারসাজিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির কথা শোনা যায়। এমনকি অর্থমন্ত্রীকেও বলতে শুনি।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবী মনে করছেন রায় সঠিক হয় নাই, আপনারা বলছেন এটা পজেটিভ। পত্রপত্রিকা পড়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে এ মামলার মেরিট দুর্বল। এটা আপিলের রায়ে দেখা যাবে।’

‘যখন নিম্ন আদালত কোন মামলার রায় দেয়, এ মামলায় উচ্চ আদালতে জামিন দেবে কি দেবে না এ সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাঁরা নিম্ন আদালতের নথিপত্র তলব করে না- এটা আপিল বিভাগের সাধারণ রেওয়াজ। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের নথিপত্র তলব করে আপিলের শুনানির সময়। এটা আমাদের জানা নলেজ। এটা কেন অন্য কিছু হয়, তা আমরা পরে বুঝব।’

খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা গ্রেভিটি অব অফেন্স থাকে তাহলে আমরা মামলায় জামিনের বিরোধিতা করি। এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর এ পর্যন্ত কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এভাবে ট্রায়াল হয়েছে? এতিমের কোন টাকার প্রশ্ন আসছে? সরকার প্রধান হিসাবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাজা হয়েছিল জনতা টাওয়ার মামলায় এবং তাঁর ঘরে এক কোটি ৯০ লাখ টাকা পাওয়া বিষয়ের মামলায় প্রথমে রায় হলো। পরে আপিল তাকে বেকুসর খালাস করে দিলো।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘১৯৬৫ সালে  বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলায় রায় হয়েছিল ট্রায়াল কোর্টে, যা পরে আপিলে টিকে নাই। যখন এ মামলার রায় হয়েছিলো তখন কি মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছিল? না, জানায়নি। তখন আন্দোলন গড়ে উঠার পেছনে এ মামলারও গুরুত্ব আছে। আপনারা (দুদক) এ মামলার রায়কে বিরাট ঘটনা হিসেবে দেখতে পারেন। কিন্তু এ উপমাহাদেশের কোন দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কোন দুর্নীতি মামলায় শাস্তি পেলে মানুষ তা সহজভাবে দেখে না।’

‘উচ্চ আদালত অবশ্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। কিন্তু পলিটিক্যাল সেনসেটিভ মামলায় উচ্চ আদালতের প্রতি সরকারের খবরদারি থাকেই। এর সর্বশেষ উদাহরণ ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের পরের ঘটনাসমূহ। এ রকম উদাহরণ অনেক আছে। পলিটিক্যাল সেনসেটিভ মামলা নয়, এমন ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত তাদের স্বাধীনতা বজায় রেখে কাজ করে এবং সফলও হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কী হয়, সেটা আমাদের দেখার আছে।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৮ ৫:০৭ অপরাহ্ণ