দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মাটিতে রেখে এ সংকটের সমাধান হবে না। তাদেরকে দ্রুত ফেরত পাঠাতে হবে, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে। দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ প্রয়োগের সঙ্গে সু চি সরকারকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে সহায়তা করা উচিত। এ অভিমত কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা বলেছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া খুবই ধীর গতিতে চলছে। এর ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে পারে।
সমস্যাটি অনেক পুরনো হলেও সাম্প্রতিককালে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন শুরু হয়। গত ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আগে থেকেই বাংলাদেশে তিন থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনীর বর্বরতার মুখে দেশ ত্যাগের কারণে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মারাত্বকভাবে কমে গেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনের রোহিঙ্গাদের গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়া এবং সিতওয়েতেও নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। ফলে এখনও আসছে রোহিঙ্গারা।
এই অবস্থার মধ্যে আজ ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৈঠকে বসছে। বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যায় জড়িত জেনারেলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা আসতে পারে। সবশেষ ভয়াবহ আকারে রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের নতুন রাষ্ট্রদূত লুইন ও। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকের পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করাসহ সহযোগিতা জোরদারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। তবে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের প্রশ্নে কিছুই বলেননি।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারপর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান এটাকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যবই দৃষ্টান্ত’ বলে অভিহিত করেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়। তারপর মাঠপর্যায়ের চুক্তি ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার পরিবারভিত্তিক তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মিয়ানমার এখন এই তালিকা যাচাই-বাছাই করবে।
জানতে চাইলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া খুবই ধীর হবে বলে মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রণয়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ। ২০টি তথ্য তারা চেয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮০৩২ জনের তালিকা দিতে পেরেছে। এটা থেকেই স্পষ্ট যে, তালিকা প্রণয়নের কাজটা অনেক কঠিন। তালিকা সঠিক না হলে প্রত্যাবাসন আরও দেরি হবে। রোহিঙ্গাদের নিজস্ব একটা নাম আছে। অফিসিয়াল নাম তার থেকে ভিন্ন। এসব খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে তালিকা করতে হবে।’
তিনি বলেন যে, রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালালে এবং বুলডোজার দিয়ে রোহিঙ্গা গ্রাম সমান করে দিলে রোহিঙ্গারা কীভাবে সেখানে যাবে। রাখাইনে যে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই এ দু’টি ঘটনাতেই তা স্পষ্ট। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে এমন কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফিরে। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী হন। অনুপ কুমার চাকমা মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে জাতিসংঘের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন রাজ্যে পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে পরিকল্পনা করলে চলবে না। এটা না করলে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ক্যাম্পে (আইডিপি) পাঠিয়ে দেবে মিয়ানমার। ইতিপূর্বে ২০১২ সালেও অনেককে আইডিপি ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে হবে যে, অধিকার ফিরে পেতে হলে তাদের মিয়ানমারেই ফিরে যেতে হবে।’ বাংলাদেশের এই সাবেক রাষ্ট্রদূত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এই নাগরিকত্বের কথা বাংলাদেশে বসে বললে হবে না। তাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে।’
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি