নিজস্ব প্রতিবেদক:
শোক ও শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে জাতি। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে হাজারও মানুষের ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে হাজির হয়েছেন নারী, পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুলের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছেন। ছোট ছোট শিশুরাও পুষ্পস্তপক অর্পণ করেছে। ফুলে ফুলে ভরে গেছে শহীদ মিনার।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র, যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে দৃপ্ত পায়ে রাজপথে নেমে আসে। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীন হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক।
তাদের এই আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা। মায়ের ভাষার মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি বাঙালি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নতুন প্রেরণা। আর এই বিজয়ের পথ বেয়ে সূচিত হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন যার পরিণতি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তাই একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পৃথিবীর বুকে অনন্য। বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। তাই এই দিনটি বাঙালির অহংকারের দিন। জাগরণের দিন। তবে এই অর্জন এখন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয় সারা বিশ্বে। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।
গর্ব আর শোকের এই দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করছে জাতি। গতকাল দিবাগত রাতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শুরু হয়।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর দুজন কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান।
পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। এরপর শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী, ডেপুটি স্পিকার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, তিন বাহিনীর প্রধান, আইজিপি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। পরে শহীদ মিনার এলাকা জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপর মানুষ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, যা এখনো অব্যাহত আছে।
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশেও হাজার হাজার মানুষকে জাড়ো হয়েছেন। অনেকেই তাদের বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেছে। শাহবাগ, আজিমপুর, নীলক্ষেতসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রতিটি প্রবেশপথেই মিছিলের সারি লক্ষ্য করা গেছে। শহীদ মিনারের আশপাশের এলাকায় মাইকে অনবরত বাজানো হচ্ছে,‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও শোকের আবহ দেখা গেছে। অনেকের হাতে-গালে শহীদ মিনারের প্রতীক শোভা পাচ্ছে। শহীদ মিনারে আসা নগরবাসীর পোশাকেও রয়েছে একুশের চেতনার ছাপ। পোশাকে সাদা আর কালো রঙের ব্যবহার বেশি। তাতে খচিত রয়েছে বর্ণমালা, কবিতার চরণ বা গানের কলি। আবার লাল-সবুজের বাংলাদেশকে ধারণ করতে দেখা গেছে কারও কারও পোশাকে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকানে এবং হাতে করে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছেন ছোট ছোট পতাকা,একুশের বাণী লেখা মাথায় বাঁধার ফিতা, শহীদদের ছবিসহ পোস্টকার্ড।
একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আজ জাতীয় ছুটির দিন। জাতীয় গ্রন্থ মেলাও খুলেছে সকাল থেকেই। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের হাত ধরে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলাপ্রাঙ্গন। অনেকে বইও কিনছেন। আশপাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও শত লোক হাত ধরাধরি করে নিজেদের মতো করে দিনটি উৎযাপন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় শোনা যাচ্ছে একুশের গান।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ