২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:২০

প্রশ্নফাঁস : মূল হোতাদের শনাক্ত করতে সম্পূর্ণভাবে পুলিশ ব্যর্থ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে এখন হাত বাড়ালেই মিলছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। রাজধানীসহ সারাদেশে ইয়াবা-ফেনসিডিলের মতো এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও মিলছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে দেশে বর্তমানে মাদকদ্রব্যের চেয়েও কম দামে প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে। একটি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকায়। এক বোতল ফেনসিডিলের দাম অন্তত ৭০০ টাকা। সেখানে একসেট ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০০-৩০০ টাকার বিনিময়ে।

এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়েছে। তবে কারা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফাঁস করা প্রশ্ন মোবাইলে পাওয়া যাওয়ার অভিযোগে সারাদেশে গত ১০ দিনে শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ অন্তত ১৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ-র্যাব। তবে তাদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের মূল উৎস জানতে পারেনি তারা। এখনও গ্রেফতার হয়নি কোনো রাঘববোয়াল।

অনেকেই বলছেন, এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে শুরু থেকেই গা-ছাড়া ভাব ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এদিকে, প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকারের নেওয়া কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। আগাম ঘোষণা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কয়েকটি চক্র প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাই যেন অসহায় হয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়।

একদিন আগে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও বলেছিলেন, প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বহু মানুষের সম্পৃক্ততা থাকায় এ পদ্ধতির পরিবর্তন ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ সম্ভব নয়।

এদিকে, গতকালও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তাদের কেউ মূল হোতা নন। এ ছাড়া গতকাল বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি এবং ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই কমিটির সদস্যসংখ্যা হবে পাঁচজন করে। এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছেন আদালত।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রশ্নফাঁসে বেশ কয়েকটি স্তর রয়েছে। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে সম্পৃক্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। তবে গোড়ায় যারা রয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে মুফতি মাহমুদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অবৈধ বাণিজ্য করছে। বাণিজ্য না হলে কেন ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করতে যাবে?

ডিবি উত্তরের উপকমিশনারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের গোড়ার মূল হোতাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে সেই তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। মূল হোতাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

তিনি জানান, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তারা পরীক্ষা শুরুর ২০-৩০ মিনিট আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দেয়।

গত দেড় বছরে পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় প্রায় পাঁচশ’ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মূল হোতাদের সংখ্যা হাতেগোনা। এ ছাড়া গ্রেফতার প্রায় সবাই এরই মধ্যে জামিন পেয়েছে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় যে ধারায় মামলা হয়, তাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ২০১২ সালের পর থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত ৮০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তবে এবার এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে।

হোতাদের না ধরতে পারলেও শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, রাঘববোয়ালদের তথ্য পাওয়ার জন্য চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে। তবে চুনোপুঁটিদের ধরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এখনও কোনো রাঘববোয়াল ধরা যায়নি।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরেক কর্মকর্তা মনে করেন, জঙ্গিরা তথ্যপ্রযুক্তিতে অত্যন্ত দক্ষ হওয়ার পরও পুলিশ-র্যাবের চৌকস সদস্যরা অল্প সময়ের মধ্যে তাদের শনাক্ত করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করেছেন। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার বিষয়টিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। একইভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে সব পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে দ্রুত তা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮ ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ