স্পোর্টস ডেস্ক:
গতবছর ভারত মহাসাগরের ওপারের এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির মাটিতে নিজেদের শততম টেস্ট জিতে সিরিজ ১-১ ব্যবধানে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। তাই এবার দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজেও ভাল করার প্রত্যয় ছিল বাংলাদেশের। চট্টগ্রামে সিরিজের প্রথম টেস্টটি ড্র করে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছিল টাইগাররা। কারণ, দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টটি যে মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’এ। যেখানে সর্বশেষ খেলা দুই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মত দেশকে হারিয়েছে তারা। তাই পয়মন্ত এই মাঠে এবার শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মত তাদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ। তবে তা স্বপ্নই রয়ে গেছে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের জন্য। শনিবার দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা চা-বিরতিতে গড়ানোর অনেক আগেই বাংলাদেশকে ২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে লঙ্কানরা। তাদের দেয়া ৩৩৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১২৩ রানে অল আউট হয়ে লজ্জার পরাজয় বাংলাদেশের। ত্রিদেশীয় সিরিজের পর শ্রীলঙ্কার কাছে বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ হারল। ১-০ ব্যবধানে।
এই টেস্ট শুরু হওয়ার আগেই দুই দলের অধিনায়ক পিচ দেখে বলেছিলেন, ম্যাচটি চট্টগ্রামের মত নিস্ফলা হবে না। আর মিরপুরের উইকেট বরাবরই স্পিন-বান্ধব। টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই সাফল্যই এই উইকেটের টার্ন কাজে লাগিয়ে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই উইকেটই যে বুমেরাং হয়ে আঘাত করবে বাংলাদেশকে তা কে জানত! টাইগার ব্যাটসম্যানরাও কি এই অজুহাতে তাদের দায় এড়াতে পারবেন?
অথচ এই ম্যাচটি বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকেরও হতে পারত। চার বছর পর টেস্ট দলে ফিরে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন এই ৩৫ বছর বয়সী। ঢাকা টেস্টে টস হেরে বোলিং করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। রাজ্জাক পেয়েছিলেন ৪ উইকেট। তার সাথে আরেক বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামের ৪ উইকেটে প্রথম দিন চা-বিরতির পরপর শ্রীলঙ্কাকে ২২২ রানে অল আউট করে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষকে কম রানে আটকে রেখে টাইগাররা যে তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়েছিল তা দিন শেষ হওয়ার আগেই দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। মাত্র ৫৬ রান তুলতেই বাংলাদেশ সেদিন হারায় শীর্ষ ৪ ব্যাটসম্যানের উইকেট। এর পেছনে শুধু লঙ্কান বোলার নয়, অবদান ছিল টাইগার ব্যাটসম্যানরাও। দুলকি চালে রান নিতে গিয়ে আউট হন প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান মুমিনুল হক। পেসার সুরঙ্গা লাকমালের বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হন মুশফিকুর রহীম। কারো আউটই দৃষ্টিসুখকর ছিল না। দ্বিতীয় দিনটিও ছিল ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় লেখা। এদিন লাঞ্চ বিরতির আগে ১১০ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। দলটি শেষ ৫ উইকেট হারিয়েছে মাত্র ৩ রানে। একপ্রান্তে ছিলেন আগের দিন নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামা অল রাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। দলের এই ব্যাটিং বিপর্যয়ে তিনিই ব্যতিক্রম, অপরাজিত থাকেন ৩৮ রানে। শ্রীলঙ্কা তখন বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ১১২ রানে।
দ্বিতীয় দিন লাঞ্চবিরতির আগ থেকে দিনের বাকি অংশ ব্যাট করেছে শ্রীলঙ্কা। ভাল শুরু পায়নি তারাও। কিন্তু তাদের সব ব্যাটসম্যানই চেষ্টা করেছেন দলের জন্য কার্যকর অবদান রাখার। সাথে ছোট ছোট কিছু জুটিতে দিন শেষ হওয়ার আগে ৮ উইকেট হারিয়ে ২০০ রান করে লঙ্কানরা। স্রোতের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করে প্রথম ইনিংসের মত দ্বিতীয় ইনিংসেও হাফসেঞ্চুরি করেন ব্যাটসম্যান রোশেন সিলভা। লেজের ব্যাটসম্যান লাকমালকে নিয়ে তার লড়াইয়ে শনিবার, তৃতীয় দিন সকালে স্কোরবোর্ডে ২২৬ রান তোলেন তিনি। তাদের জুটি যোগ করে ৪৮ রান। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল শেষ দুই উইকেট হাতে নিয়ে অনেকদূর যাবে শ্রীলঙ্কা। তবে তাইজুল পরপর দুই বলে লাকমাল ও রঙ্গনা হেরাথকে ফিরিয়ে দিলে সেই ২২৬ রানেই শেষ হয় দলটির দ্বিতীয় ইনিংস। তাইজুল আবার পান ৪ উইকেট। বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৩৯ রানের। যেখানে মিরপুরে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড হলো ২০৯ রানের। হাতে দুই দিন থাকলেও এত বিশাল রানের লক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য অনেক চাপেরই।
সেই চাপেই ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার। লাঞ্চবিরতির আগে দলীয় ৪৯ রানের মধ্যে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসকে হারায় দলটি। লাঞ্চ থেকে ফিরে দলীয় ৬৪ রানে ফিরে যান আগের টেস্টের নায়ক মুমিনুল হক। তার ৩৩ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ এই ইনিংসে। দলীয় ৭৮ রানে ফিরে যান লিটন দাসও।
এরপর নামেন এই সিরিজে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ক্রিজে তার সঙ্গী তখন মুশফিকুর রহীম। প্রথম টেস্টে দারুণ লড়াকু ব্যাটিং করা এই দুই ব্যাটসম্যানের দিকে তখন তাকিয়ে সবাই। কিন্তু দলীয় ১০০ রানে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন মাহমুদউল্লাহ। এরপরই ধস নামে বাংলাদেশের ইনিংসে। ১০৪ রানের মধ্যে উইকেট হারান আরো তিন ব্যাটসম্যান। ১১৩ রানে বাংলাদেশ হারায় নবম উইকেট। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর এই ইনিংসে ১ রান করেন সাব্বির রহমান। আর লেজের কেউ প্রতিরোধ করতে না পারায় ১২৩ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। তিন লঙ্কান স্পিনার- হেরাথ, দিলরুয়ান পেরেরা ও আকিলা ধনঞ্জয়া মিলে নিয়েছেন বাংলাদেশের সবগুলো উইকেট। এদের মাঝে এই টেস্টে অভিষিক্ত অল রাউন্ডার আকিলা পেয়েছেন ৫ উইকেট। প্রথম ইনিংসে তিনি পেয়েছিলেন ৩ উইকেট। এছাড়া হেরাথ শিকার করেছেন চার উইকেট। অন্যটি পেয়েছেন দিলরুয়ান।
চলতি সিরিজে সর্বোচ্চ ১২ উইকেট পেয়েছেন তাইজুল। দুই সেঞ্চুরিতে সর্বোচ্চ ৩১৪ রান মুমিনুলের। তবে দ্বিতীয় টেস্টের দুই ইনিংসে ফিফটি হাকানো লঙ্কান ব্যাটসম্যান রোশেনকে দেয়া হয়েছে ম্যাচ সেরা ও সিরিজ সেরার পুরস্কার। দুই ফিফটি ও এক সেঞ্চুরিতে সিরিজে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৩৫ রান করেছেন তিনি।
অবশ্য দুই দলের দ্বৈরথ এখানেই শেষ নয়। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ থেকে দুই ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর-
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংস : ২২২/১০ (৬৫.৩ ওভার) (কুশল মেন্ডিস ৬৮, করুনারত্নে ৩, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা ১৯, গুনারত্নে ১৩, চান্ডিমাল ০, রোশেন ৫৬, ডিকভেলা ১, দিলরুয়ান ৩১, ধনাঞ্জয়া ২০, হেরাথ ২, লাকমাল ৪*; মিরাজ ০/৫৪, রাজ্জাক ৪/৬৩, তাইজুল ৪/৮৩, মোস্তাফিজ ২/১৭)।
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ১১০ (৪৫.৪ ওভার) (তামিম ৪, ইমরুল ১৯, মুমিনুল ০, মুশফিক ১, লিটন ২৫, মিরাজ ৩৮*, মাহমুদউল্লাহ ১৭, সাব্বির ০, রাজ্জাক ১, তাইজুল ১, মোস্তাফিজ ০; লাকমাল ৩/২৫, দিলরুয়ান ২/৩২, আকিলা ৩/২০, হেরাথ ০/৩১)।
শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংস : ২২৬ (৭৩.৫ ওভার) (করুনারত্নে ৩২, মেন্ডিস ৭, ধনাঞ্জয়া ২৮, গুনারত্নে ১৭, চান্দিমাল ৩০, রোশেন ৭০*, ডিকভেলা ১০, দিলরুয়ান ৭, আকিলা ০, লাকমাল ২১, হেরাথ ৯; রাজ্জাক ১/৬০, মোস্তাফিজ ৩/৪৯, তাইজুল ৪/৭৬, মিরাজ ২/৩৭)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : ১২৩ (২৯.৩ ওভার) (তামিম ২, ইমরুল ১৭, মমিনুল ৩৩, মুশফিক ২৫, লিটন ১২, মাহমুদউল্লাহ ৬, সাব্বির ১, মিরাজ ৭, রাজ্জাক, ২, তাইজুল ৬, মোস্তাফিজ ৫*; লাকমাল ০/১১, দিলরুয়ান ১/৩২, হেরাথ ৪/৪৯, ধনঞ্জয়া ৫/২৪)।
ফলাফল : শ্রীলঙ্কা ২১৫ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : রোশেন সিলভা।
ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট : রোশেন সিলভা।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ