২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৫৬

বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় আগামীকাল, সারাদেশে আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আগামীকাল ৮ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়। ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের বিশেষ আদালত -৫ এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। রায়কে ঘিরে দেশব্যাপী ব্যাপক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। চলছে গ্রেফতার, তল্লাশিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা তৎপরতা। সেই সাথে ক্ষমতাসীন দল-আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল- বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, হুশিয়ারি ও রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন পুরো জাতি।

এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা বহন নিষিদ্ধ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর থেকে বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পোশাকধারী পুলিশসহ সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, রাজধানীতে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি ও পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করছে পুলিশ। রায়কে ঘিরে এরই মধ্যে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, নাজিমুদ্দিন আলম, হাসান মামুন, এবিএম মোশাররফ হোসেনসহ সারা দেশে দুই সহস্রাধিক বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, ঢাকায় প্রবেশদ্বার- যাত্রাবাড়ী, আবদুল্লাহপুর, সদরঘাট, গাবতলীসহ সব পথে ব্যাপক তল্লাশি অভিযানসহ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর প্রবেশপথে পুলিশের এ কড়াকড়ি আরোপ করা হয় বলে প্রত্যাক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, মঙ্গলবার ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের- ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও চট্টগ্রামে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কার কথা জানিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরা পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। এ জন্য যা করা দরকার পুলিশ তাই করবে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
দেশব্যাপী গণ-গ্রেফতার অভিযান
৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার রায়কে সামনে রেখে সারা দেশে গণ-গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক সপ্তাহে অন্তত দুই হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে টঙ্গীতে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারেসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

৬ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের পর তাকে আটক করা হয়। হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও গাজীপুর পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া, টঙ্গী থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম শুক্কুরের বাড়ি তছনছ করেছে সাদা পোশাকদারী একদল পুলিশ। রোববার রাতে এ তল্লাশি চালায় পুলিশ।

অপরদিকে, সিরাজগঞ্জে বিএনপি-জামায়াতের ৫ নেতাকর্মী,    চুয়াডাঙ্গায় বিএনপি-জামায়াতের ৩৯ জন, সুনামগঞ্জে বিএনপির ২১ নেতাকর্মী, পাবনায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ গ্রেফতার ৫ জন, বাগেরহাটে বিএনপির ৭ নেতাকর্মী, রংপুরে জামায়াতের ৩ নেতা, মাদারীপুরে বিএনপি ও জামায়াতের সেক্রেটারিসহ ৯ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোঃ শাহাদৎ হুসাইন আটক হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে গ্রেফতার করা হয়।
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বিএনপির ৮ নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর আদালতের নির্দেশে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সোমবার বিকেলে গ্রেফতারের পর রাত ১১টার পরে তাদের কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

চাঁদপুরে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানসহ বিএনপি’র ২০ নেতাকর্মী আটক করেছে জেলার বিভিন্ন থানা পুলিশ। এর মধ্যে সোমবার রাতেই বেশ কয়েক জনকে আটক করেছে সদর থানা, হাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ।
নাশকতার আশঙ্কায় নোয়াখালী জেলা পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে সোমবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আলাউদ্দিনসহ ১১ নেতাকর্মীকে আটক করেছে।
এদিকে, সোমবার খালেদা জিয়ার সিলেট সফর উপলক্ষে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ মুশফিক আহমেদ।

ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদলের কেসি কলেজ শাখার সভাপতি আব্দুস সালামসহ বিএনপি ও জামায়াতের ৬৯ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে এসে সোমবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনিপর সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন ও নজরুল ইসলাম আজাদসহ ৬ বিএনপি নেতা। এর আগে, শনিবার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা আবুল বাশার বাদশাসহ বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের ১১ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। পরের দিন রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীবকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রোববার বিকেল ৫টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের মিশনপাড়ার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
সাতক্ষীরায় বিএনপি জামায়াতের ১০ নেতাসহ ৩৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে তালা ইসলামকাটি ইউনিয়ন  জামায়াতের সভাপতি শাহিন মোড়ল(৩৫), দেবহাটা বয়েরা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শহিদুর ইসলাম (৫২) রয়েছেন।
যশোর বিমানবন্দর থেকে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আটক

ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এড এম এ মজিদকে রোববার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাত সোয়া ৮টার দিকে যশোর বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার
মুন্সীগঞ্জ শহরের থানারপুল এলাকা থেকে বিএনপির ৩ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার সদর থানার পুলিশ তাদের আটক করেছে।
নড়াইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি জুলফিকার আলী মন্ডলকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার গভীর রাতে নড়াইলের আলাদাৎপুর এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে তাকে আটক করা হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি-জামায়াতসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে তল্লাশি ও হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সাথে বিএনপি নেতাকর্মীরা গ্রেফতার এড়াতে দলীয় কার্যালয়ে তালা দিয়ে রেখেছেন। অনেকে রাতে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকছেন। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারি রায় খালেদা জিয়ার বিপক্ষে গেলে দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠে নামার ও সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেয়ার কথা বলছেন। সেই সাথে সারা দেশ অচল করে দেয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন তৃণমূলের বিএনপি নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতারাও যেকোনো মূল্যে নেত্রীকে জেলে পাঠানোর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে জেতে দিবো না।’
৮ ফেব্রুয়ারি কি রায় হবে?
এদিকে আগামীকাল ৮ ফেব্রুয়ারি রায় আদৌ হবে কিনা এ নিয়েও নানা মহলে গুঞ্জন চলছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রায়ের তারিখ পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। কেউ আবার বলছেন, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় মনে হচ্ছে রায় হবে এবং বিএনপি চেয়ারপারসনে সাজা দেয়া হবে। কেউ আবার বলছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে  দেয়া হলে তাকে কি কারাগারে নেয়া হবে নাকি গৃহবন্দী করা হবে? এ নিয়েই একেকজন একেক কথা বলছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ বলছেন, আগামীকালই খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণা হবে এবং তাকে সাজা দেয়া হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও বেগম জিয়অ নিয়ে রেখেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে কী রায় ঘোষণা হতে পারে এ নিয়েও আছে আলোচনা-পর্যালোচনা।
কী রায় হতে পারে?
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষ কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। প্রসিকিউশনের কোনো এভিডেন্সেই মামলাটি প্রমাণিত হয়নি। সর্বোপরি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়নি। তারা আশা করছেন- আদালত সাক্ষ্য, কাগজপত্র, তথ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিলে এ মামলায় খালেদা জিয়া বেকসুর খালাস পাবেন। আইনজীবীরা জানান, ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী হিসেবে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এবং দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন হয়েছে। ফলে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ্ড বা জরিমানা হিসেবে অর্থদণ্ডও হতে পারে। এই ধারায় আদালত কারাদ- না দিয়ে শুধু জরিমানা দণ্ডও করতে পারেন। কেননা এই ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
বিএনপির আইনজীবীরা জানান, রায় ঘোষণায় সাজা হলেও তাৎক্ষণিক উচ্চ আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করার পরিকল্পনা অনেক আগেই নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে যাতে নিম্ন আদালতে সাজা হলেও আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আইনগত কোনো বাধা না থাকে।
বাদী পক্ষের দাবি অনুযায়ী, বিচারক যদি মনে করেন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাহলে এ মামলায় খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারেন। কম দণ্ড দেয়ারও ক্ষমতা আছে বিচারকের। আর আসামি পক্ষ দাবি করছে, অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি বাদী পক্ষ। তাই এ মামলায় খালাস পাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

এদিকে, সরকারের মন্ত্রীরা আদালতে বিচারধীন মামলার রায় নিয়ে আগাম কথা বলায় পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিচ্ছে। ‘১৫ দিনের মধ্যে খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হবে’, ‘একদিনের জন্য হলেও খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হবে’, ‘নির্বাচন বন্ধের চেষ্টা হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসবে’ বা ‘বাতাসে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পাওয়ার কথা বলছেন তারা। এতে রাজনৈতিক মাঠে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়। এরই মধ্যে মামলার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে রায় ঘোষণার দিন নির্ধারিত হওয়ায় মন্ত্রীদের বক্তব্যের সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পাচ্ছে বিএনপি। তাই বিএনপি নেতারাও ধরেই নিয়েছেন যে, রায়ে খালেদা জিয়া দণ্ডিত হতে যাচ্ছেন।

আদালত সূত্র বলছে, ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের রায় ঘোষণা হবে। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। খালেদা জিয়াসহ ৬ আসামি হলেন- তার বড় ছেলে তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য কাজী সলিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও শহীদ জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর বকশীবাজারের বিশেষ আদালত ৫ এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করে দেন।

খালেদা জিয়ার সাজা- বিরল ঘটনা
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ ছাড়া কোনো শাসককেই মামলায় জেল খাটতে হয়নি। সাংবিধানিকভাবে তিনবার এবং গণরায়ে দুইবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়ে দন্ড দিলে ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার থেকেই তাকে জেলে যেতে হবে। পরের দু’দিন সরকারি ছুটি থাকায় খালেদা জিয়াকে থাকতে হবে কারাগারেই। মামলার সার্টিফাইড কপি ১০ ফেব্রুয়ারি, রোববার সংগ্রহ করে উচ্চ আদালতে আপিল করলে আদালত যদি জামিন দেন তাহলে হয়তো তিনি মুক্তি পেতে পারেন। তাহলে এটি হবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলাটি তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়। টানা ১০ বছর মামলার বিচার কার্যক্রম চলে। ২১৬ কার্যদিবসের মধ্যে ২৮ কার্যদিবস বেগম খালেদা জিয়া তার রাজনীতির বর্ণাঢ্য জীবন উপস্থাপন করে বক্তব্য রেখেছেন।

কী ভাবছে বিএনপি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে রাজনীতির মাঠ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ এই মামলাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য আর মামলার গতিবিধিতে বিএনপি মনে করছে, সরকার- বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠাতে চায়। এ জন্য মামলার কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করে আসছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও সে কথা আদালতে মামলা চলাকালে একাধিকবার বলেছেন।

এ নিয়ে করণীয় নির্ধারণে স্থায়ী কমিটির সভা ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় যেকোনো মূল্যে সরকারের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের নেতারা। নির্বাহী কমিটির সভায় নেতারা এ জন্য শপথও নিয়েছেন। সেই সাথে দল ভাঙা ও নির্বাচন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র রুখতে দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে তা নির্বাচন কমিশনেও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাগারে পাঠানো হলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে দলকে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। এর পর বিএনপি চেয়ারপারসন সোমবার সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহপরাণ (র.) এর মাজার জিয়ারত করে এসেছেন। আজ বুধবার বিকেল ৫টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে এসবকে আদালতের ওপর বিএনপির চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা
এদিকে, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট দায়ের করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটির বিচার কার্যক্রমও দ্রুত গতিতে এগিয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ওই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। এ মামলার রায়ও দ্রুত হতে পারে বলে ধারণা করছেন আইনজীবীরা। তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় এ মামলা করেছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ। ওই মামলার অন্য আসামিরা হলেন-খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
আরও ১৪ মামলা বিশেষ আদালতে
অরফানেজ ট্রাস্ট চ্যারিটেবল মামলায় বিচারের গতি-প্রকৃতির এই যখন অবস্থা, তখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে আরও ১৪টি মামলা বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, মামলার রায় ও আগামী দিনে দলের নেতৃত্ব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নন। খালেদা জিয়াকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি নিয়েই তাদের সব উদ্বেগ। তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, বছরের পর বছর ধরে মামলার জট তৈরি হয়েছে নিম্ন আদালতে। সেদিকে সরকারের তেমন নজর না থাকলেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোয়। বিশেষ আদালতের মাধ্যমে ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে প্রতি সপ্তাহের একাধিক দিন। তার প্রতিটি হাজিরার দিন নির্বিচারে গ্রেফতার করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। দায়ের করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা।
খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কেউ নির্বাচন করতে পারবেন কি-না, বিষয়টি আসলে আমাদের আইনে স্পষ্ট নয়। নিম্ন আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন, এটা স্বাভাবিক। উচ্চ আদালত যদি নিম্ন আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ না দেয় এবং আপিল বিচারাধীন থাকলে আইনের স্বাভাবিক হিসাব বলে-কারাগারে থেকেই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। আর উচ্চ আদালত যদি তার আপিল খারিজ করেন তাহলে অন্য কথা। তাছাড়া উচ্চ আদালতের ইদানীং কিছু রায়ে বিষয়গুলো নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সাজা হয়েছিল। হাইকোর্ট তার আপিল খারিজ করে দেয়, এরপর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ খারিজ করে নতুন করে শুনানির নির্দেশ দেয়। এর অর্থ হচ্ছে, মামলাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু মায়ার মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ তো যায়নি। আপিল করা অবস্থায় তিনি সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই এখানে মন্ত্রী মায়ার বিষয়টি একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে। এই উদাহরণ ধরে এটা বলা যায়, উচ্চ আদালতে আপিল থাকলে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার কথা নয়।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা আছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’ তাহলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন।’ তবে উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন গৃহীত হলে উচ্চ আদালত সাজা পরিবর্তন ও রায় স্থগিত করতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও নিম্ন আদালতে সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যার উদাহরণ- আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, বিএনপির লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েকজন দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
সরকারের টার্গেট
এটা পরিষ্কার যে, সরকার আইনি জটিলতার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। দলের চেয়ারপারসনকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এ মামলাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারে সরকার। সে ক্ষেত্রে শুধু আইনি লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করা সম্ভব হবে না। আবার রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার প্রেক্ষিতে নির্বাচনের সুযোগ পেলেও রায়কে হাতিয়ার করে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাবে সরকার।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮ ১০:১১ পূর্বাহ্ণ