নিজস্ব প্রতিবেদক:
সারাদেশে কর্মরত গ্রামীণ ফোনের ১৪শ’ শ্রমিক তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে ২০১১ সালে মামলা দায়েরের পর থেকেই একের পর এক হয়রানি শুরু হয় তাদের ওপর। মামলা দায়েরের পর প্রথম শ্রম আদালত শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার আদেশ দেয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে গ্রামীণফোন হাইকোর্টে রিট করলেও হাইকোর্ট পুনরায় প্রথম শ্রম আদালতকে পুনঙ্খানুপুক্ষভাবে রায়টি পর্যালোচনার আদেশ প্রদান করে। ঐ আদেশে প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে সরাসরি স্বাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করার জন্য বলা হয় এবং গ্রামীন ফোন কিভাবে জেমসন ইন্টারন্যাশনাল/স্মার্ট সার্ভিস লিমিটেডের সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের ব্যবসা পরিচালনা করছে তার পরিপূর্ণ কাগজ-পত্রাদি যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। আদালতের বিচারাধীন মামলার প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে গ্রামীণফোন শ্রমিক কর্মচারীদের ৪ বছরের ইনক্রিমেন্ট, গ্রেডিং সুবিধা, মোবাইল ফোন, নাইট বিল, ইউনিফর্ম, লভ্যাংশের ৫ ভাগসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধাসহ অনেকের বেতন বন্ধ রাখে।
শ্রমিক-কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, শ্রমিক হয়রানির বিরুদ্ধে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হাসান গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে গত ১১ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে মামলা (বি এল এ ফৌজদারি মামলা নং ২০/২০১৮) দায়ের করেছেন। মামলায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মাইকেল ফলিকে আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আসামির প্রতি সমন জারি করেছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে আদালতে হাজির হতেও আদেশ দিয়েছে আদালত।
২০১১ সালে মামলা দায়ের ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দু’দফা সামান্য বেতন বৃদ্ধি করে শ্রমিকদের নিবৃত্ত করা হয়। এরপর ৪ বছরে বেতন বৃদ্ধি তো দূরের কথা আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে শ্রমিকদের ওপর নানান দমন-পীড়ন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। নানা টালবাহানার পর শ্রমিকরা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান এমপি’র দ্বারস্থ হলে তিনি শ্রম ও কমংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ আমিনুল ইসলামকে ৪ বছরের বেতন বৃদ্ধির জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকার ফারস্ নামক একটি হোটেলে শ্রম ও কর্মস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে গ্রামীণফোন লিমিটেডের সেবায় নিয়োজিত মামলা দায়েরকারী শ্রমিক কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত বিরোধ বিষয়ে মিমাংসা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভা সম্পর্কে গ্রামীণফোনের শ্রমিক-কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়নের (বি-২১৬১ যা হাইকোর্ট কর্তৃক স্থগিত) প্রতিনিধি কিংবা কোনো শ্রমিক অবহিত ছিলেন না। স্থগিত হওয়া ঐ ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান জানান, সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূতভাবে কিছু লোক ভাড়া করে ঐ সভা করা হয় বলে তারা পরবর্তীতে জানতে পারেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি সিদ্ধান্ত পত্র তাদের ধরিয়ে দেয়া হয়। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মচারীদের জন্য গ্রামীণফোন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামীণফোনের এককভাবে নেয়া ঐ প্যাকেজের ‘ক’ তে উল্লেখ করা হয় স্ব স্ব ভেন্ডর কোম্পানি/প্রতিষ্ঠান হতে আইনানুগভাবে চাকরি হতে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে নতুন কোম্পানি/ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে উপার্জন ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ইচ্ছুকদের জন্য ৪টি মাসিক মুল বেতন, ১০ ভাগ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি তিন বছরের বকেয়াসহ, গ্রাচুইটি শ্রম আইন অনুযায়ী, অতিরিক্ত ২৪টি মাসিক মূল বেতন।
প্যাকেজের ‘খ’ তে উল্লেখ করা হয় স্ব স্ব ভেন্ডর কোম্পানি/প্রতিষ্ঠান হতে আইনানুগভাবে চাকরি হতে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিতে ইচ্ছুকদের জন্য ৪টি মাসিক মুল বেতন, ১০ ভাগ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি তিন বছরের বকেয়াসহ, গ্রাচুইটি শ্রম আইন অনুযায়ী, অতিরিক্ত ৩৮টি মাসিক মূল বেতন। প্যাকেজের ‘ক’ সিদ্ধান্ত মানলে ঐ শ্রমিককে তাদের নিয়ম অনুযায়ী অর্থ প্রদান করে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করবে এবং প্যাকেজের ‘খ’ সিদ্ধান্ত মানলে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে হবে। ঐ পত্র অনুযায়ী যারা এ দু’টি কর্মসূচি গ্রহণ করবে না তারা তাদের নিজ মামলা পরিচালনাসহ অনান্য বিষয় নিজ ইচ্ছায় পরিচালনা করতে পারবে। এমন সিদ্ধান্তের পর শ্রমিকদের পত্র ধরিয়ে দিয়ে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। শ্রমিকরা জানান, তারা আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা পূর্বক মামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের ওপর নেমে আসে নানা দমন-পীড়ন ও মানসিক নির্যাতন। এমন দমন-পীড়ন ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই প্রায় সাড়ে ৬শ’ শ্রমিক কর্মচারী স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা নানাভাবে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্থগিত হওয়া গ্রামীনফোন শ্রমিক-কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান জানান, গ্রামীণফোন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করা পত্রের নিয়মাবলী নিজেরাই মানছে না। শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়েরকৃত হাইকোর্ট থেকে প্রথম শ্রম আদালতে প্রেরণকৃত মামলার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে নানা দমন-পীড়নে শ্রমিকদের স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি জানান, গ্রামীণফোনের কর্পোরেট অফিসের এইচ আর ডিরেক্টর কাজী মোঃ শাহেদ, এডমিন ডিরেক্টর তানভীর, জিএম ট্রান্সপোর্ট আসাদুজ্জামান আসাদ, লিড ম্যানেজার আনিছুর রহমান, জিএম অনিক চৌধুরী অসাধুপায় অবলম্বন করে শ্রমিক-কর্মচারীদের বদলি আতংকে স্বেচ্ছায় অবসরে বাধ্য করান। প্রথমে একজন শ্রমিক কিংবা কর্মচারীকে কোনো প্রকার লিখিত পত্র না দিয়ে মৌখিকভাবে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে চলে যেতে বলা হয়। সাধারণত জহির নামে প্রশাসনের একজন ফোন দিয়ে বদলির কথা বলেন। শ্রমিক-কর্মচারীরা লিখিত পত্র চাইলে তাদেরকে চলে না গেলে নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। অথচ একযুগ ও তার চাইতেও বেশি সময় ধরে কর্মরতরা যখনই বদলি হতেন তখনই গ্রামীণ ফোনের স্ব-স্ব বিভাগ থেকে পত্রের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেয়া হতো। এ বিষয়ে জহিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি