২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৪২

হাঁড়কাপা শীতে কাবু রোহিঙ্গারা

উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :
গত কয়েক’দিন ধরে হাঁড়কাপানো প্রচন্ড শৈতপ্রবাহে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা কাবু হয়ে পড়েছেন। উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে প্রচন্ড ঠান্ডায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। শীতের শুরুতে কিছুটা (ঠান্ডা) কম হলেও গত এক সপ্তাহ ধরে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। পাহাড়ি জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গাদের শৈতপ্রবাহে জীবনযাত্রা কাহিল হয়ে পড়েছে। নারী-শিশু ও বয়স্ক রোহিঙ্গারা ছাড়াও ঝুপড়ি ঘরসহ শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গারা প্রচন্ড শীতে কাঁপছে। ফলে নারী-শিশুরা শীতবস্ত্রের অভাবে ঠান্ডাজনিতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

উখিয়া ও টেকনাফের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শিবির ও শিবিরের বাইরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। শুধু রোহিঙ্গারা নয় তীব্র হাড়কাঁপানো শীতে পুরো কক্সবাজারের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রা। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে। দুর্ভোগ-দুর্দশা বাড়ছে এ জেলার ছিন্নমূল মানুষের। কষ্টে পড়েছে বৃদ্ধ, শিশু, হতদরিদ্র মানুষ ও দিনমজুর। প্রচন্ড শীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া লোকজন ঘরের বাইরে খুব একটা বের হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, গ্রামে যাদের গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই তারা খড়কুটো জ্বালিয়ে সকাল-সন্ধ্যা শীত নিবারণের চেষ্টা করছে।

গত কয়েক’দিন ধরে দুপুরে সূর্যের মুখ দেখা গেলেও বিকেলে আরও আকাশ কুয়াশা ঢাকা পড়ে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ ধরনের শীত তারা আগে কখনও দেখেনি। শৈত্যপ্রবাহে তীব্রতা মানবদেহে কাঁটার মতো বিঁধছে। তারা জানায় এ ধরনের শীতের সঙ্গে তারা আগে কখনও অভ্যস্ত ছিল না। শীত মোকাবেলা করা নি¤œ আয়ের মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে তীব্র শীতে খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে। রুটি রুজির সন্ধানে কাজের বের হতে পারছে না তারা। প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে অনেকে ডায়রিয়া, ঠান্ডাজনিত এ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগির প্রচন্ড ভীড় লক্ষ্য করা গেছে।

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ১নং পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া গুলজার বেগম ও তার স্বামী মো:ইসলাম জানান, তাদের দেড় মাস আগে জন্ম নেয়া শিশুর জন্য কোন শিশুখাদ্য পাননি। সারাক্ষণ স্বর্দি-কাশি লেগেই আছে বলে জানায় তার বাবা। শীতে গরম কাপড়ের অভাবে শুধু গুলজার বেগমের নয়, তার মতো লাখো শিশুর একই অবস্থা। জীবনের শুরুতে রোহিঙ্গা পরিচয় নিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। চোখের সামনে বার্মিজ সেনাদের হত্যাযজ্ঞ চালাতে দেখেছে তারা। যে দৃশ্য এখনো তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রাখছে।

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের অবস্থিত বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. বাছেদুর রহমান সোহেল বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। টেকনাফের মৌচনি নিবন্ধিত শিবিরের প্রধান সড়কের সামনে গড়ে উঠেছে নতুন করে শতাধিক রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। সেখানে অনেকের ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে কাদা মাঠিতে বসবাস করছে। এমন এক রোহিঙ্গা নারী তসলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি মিয়ানমার কিলাডং গ্রামে। তিনি জানান, শীত শুরুতে তেমন বেশি শীত লাগেনি। কিন্তু গত দুইদিন ধরে ঠান্ডায় খুব কষ্টে হচ্ছে। কথা বলার সময় কোলে ছিল ৫ মাস বয়সের শিশু মিনারা বেগম। তার সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে। পাশে থাকা অপর দুই সন্তান মামুন ও শফিকার গায়েও গরম কাপড়চোপড় নেই। হাত পা গুটিয়ে মায়ের পাশে বসে আছে।

টেকনাফ মৌচনি প্রধান সড়কের সামনে ঝুপড়ি ঘরে নতুন আসা রোহিঙ্গা তসলিমা আক্তার জানান, এক কাপড়ে তাঁরা মিয়ানমার ছেড়েছেন। গরম কাপড় তো দূরে, প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। এখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে সন্তানেরা। মিনারা বেগম অসুস্থ হলেও তাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। টেকনাফের নয়াপাড়া ত্রাণ কেন্দ্রের পাশে ধানে জমিতে নতুন করে ঘর তৈরী করতে দেখা যায়। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে অনেকে আবার ছাউনি দিতে পারেননি। বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত ১৫ ফুট লম্বা একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন পরিবারের ২০ নারী ও শিশু। নারীদের সঙ্গে আছে পাচঁ মাস থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ৫ জন শিশু। ঠান্ডায় (শীতে) বেশির ভাগ শিশু সর্দি-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। কিছু শিশুর গায়ে কাপড়ও নেই। আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসিনি। আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি-সহায়সম্বল সবকিছু হারিয়েছি। শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের জন্য এই ঝুপড়িঘরে কারও ঘুম হয় না। রাতে ঝুপড়িঘরের বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। একটা কম্বল কিংবা গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের শীত নিবারণেরও কোনো জো-নেই। এর মধ্যেও খাবারের সংকটও চলছে।

উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, গেল বছরের শেষ দিকে শুরু হওয়া শীতের প্রকোপ এখনও কমেনি। তার উপর চলছে শৈতপ্রবাহ। অর্ধ শতাব্দীতে রেকর্ড গড়েছে এ তাপমাত্রা। প্রচন্ড শীতের কারণে হাসপাতালে বেড়েছে শিশু রোগির সংখ্যা। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি সেবা দিতে। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার টিটু চন্দ্র শীল বলেন, শীতকালে পাহাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধ, নারী-শিশুরা ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ইনফেকশন, রক্ত ঝরা ও চোখের এলার্জিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তও হচ্ছে। তবে সকলে যাতে চিকিৎসা সেবা পায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তবে শীতকাল আসার পর থেকে রোগীর সংখ্যাটা বেড়েছে।

দৈনিক দেশজনতা /এন আর

প্রকাশ :জানুয়ারি ১০, ২০১৮ ৮:৫৬ অপরাহ্ণ