নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৬ জন চিকিৎসককে (ওএসডি) সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন স্থানে বদলি আদেশ দিলেও তাদের অনেকেই ঢাকা ছাড়েননি। এ ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রী কড়া হুশিয়ারি দিলেও তা উপেক্ষা করে তারা পূর্বের কর্মস্থলে বহালতবিয়তে আছেন।
এ বিষয়ে সরেজমিন গত ২ জানুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় বদলি আদেশ পাওয়া নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. কে এম মামুন মোর্শেদ তার নিজ কক্ষে কাজ করছেন। অথচ তাকে গোপালগঞ্জ জেলার শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে বদলি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত্মও তিনি ওই মেডিকেল কলেজে যোগদান করেননি বলে নিশ্চিত করেছেন ওই কলেজের নবনিযুক্ত প্রিন্সিপাল ডা. আমিনুল হোসেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে বদলিকৃত কতজন ডাক্তার এ পর্যন্ত্ম রিলিজ নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মামুন মোর্শেদ যায়যায়দিনকে বলেন, আদেশপ্রাপ্ত সবাই রিলিজ নিয়ে চলে গেছেন। তবে তাদের নামের তালিকা চাওয়ায় এটি মন্ত্রণালয়ের কাজ, হাসপাতাল কোনো তথ্য দিতে পারবে না বলে জানান। পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনে দরখাস্ত্মের মাধ্যমে তথ্য নিতে বলেন। সে সময় হাসপাতালটির পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া দেশের বাইরে অবস্থান করায় ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে তাকে বিভিন্ন ফাইলপত্রে স্বাক্ষর করা এবং মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে যোগ দিতে দেখা যায়। পরে প্রশাসনিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৩৫ জনের বদলি হলেও ২ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম মাত্র ১৭ জন চিকিৎসক রিলিজ স্স্নিপ নিয়েছেন।
ডা. কে এম মামুন মোর্শেদ ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা রহিম ও স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজির সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুদ ইকবালকেও গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলেও তারাও সেখানে যোগদান করেননি।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. রৌনক জাহানকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু গত ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম তিনি সেখানে যোগদান করেননি বলে ওই স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সটির হিসাবরক্ষক সুবোধ চন্দ্র দাস যায়যায়দিনকে জানান। নাক-কান-গলা বিভাগের ডা. মো. আসাদুর রহমানকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে বদলি করলেও নির্দেশ পাওয়ার পর যোগদানের কথা ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম তিনি সেখানে যাননি। একইভাবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ডা. শামসী সুরাইয়া আশিকীও জেলা চাঁপাই সদর হাসপাতালে যোগদান করেননি।
ঢামেক থেকে গাইনি অবস বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শামিমা রহমানকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ও সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডা. আকতার জাহানকে (গাইনি অ্যান্ড অবস) কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হলেও ওভার পোস্টিংয়ের কারণে তারা জয়েন করেননি।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট তাসলিমা নিগারকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে এবং জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের অ্যানেসথেশিয়া চিকিৎসক ডা. মো. মাহবুবে মোস্ত্মফাকে পিরোজপুর জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত্ম তারাও সেখানে যোগদান করেননি।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, কয়েক মাস আগেও ৩০ জন চিকিৎসককে বদলি করা হয় যাদের অনেকেই তদবির করে ফের ঢাকায় ফিরে এসেছেন। এবার অবশ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আদেশ দিয়েছেন। ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করলে পরদিন থেকেই বদলিকৃতরা অবমুক্ত বলে গণ্য করা হবে। ওএসডি হিসেবেও বেতন-ভাতা পাবেন না বলে আদেশে উলেস্নখ করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সাইদুজ্জামানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে নির্দেশপ্রাপ্ত ২৫ জনের মধ্যে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম ১৭ জন চিকিৎসক রিলিজ স্স্নিপ জমা দিয়েছেন। তবে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের দুইজন চিকিৎসকের বদলি আদেশ স্থগিত করা হয়েছে। বাকিরা নির্ধারিত কেন্দ্রে চলে গেছেন। আর যারা এখনো রিলিজ স্স্নিপ জমা দেয়নি ২৮ তারিখের পর অটোমেটিক্যালি তাদের বদলি কার্যকর হয়ে গেছে। এমনকি একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন তার জন্যও এ আদেশ বহাল থাকবে।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ১০৬ জনকে বদলি করার পরও ওএসডি পোস্টিং নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো প্রায় দুই শতাধিক চিকিৎসক সংযুক্তিতে রয়েছেন। যাদের মধ্যে রাজধানীর চার হাসপাতালেই ১৪০ জন ওএসডি পোস্টিং নিয়ে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে দায়িত্বরত ৪৮ জন, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ৩৮ জন, সলিমুলস্নাহ মেডিকেলে ২২ জন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৩২ জন। অন্যরা মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, নিটোর, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক পরিচালক ডা. সমিরকান্ত্মি সরকার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ শোনার পরপরই ঢাকার বাইরে বদলি আদেশপ্রাপ্ত সবাই নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। তবে যারা এখনো যাননি আদেশ অনুসারে ২৮ ডিসেম্বর থেকে তারা তাৎক্ষণিক অবমুক্ত হয়েছেন। তাই পূর্বের কর্মস্থলে কেউ থাকলেও সেখানে কোনো রকম বেতন-ভাতা পাবেন না।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে যুগ্মসচিব এ কে এম ফজলুল হক স্বাক্ষরিত এক বদলি আদেশপত্রে বিভিন্ন সময় ওএসডি (সংযুক্তিতে) পোস্টিং নিয়ে ঢাকায় অবস্থানরত তিন শতাধিক চিকিৎসকের মধ্যে ২১ ডিসেম্বর রাতে ১০৬ জনকে বদলি করা হয়। ২৭ ডিসেম্বর বুধবার ছিল তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগদানের শেষ দিন।
এসব চিকিৎসকের মধ্যে অধ্যাপক ৩ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১৪ জন, সহকারী অধ্যাপক ৬ জন, সিনিয়র কনসালট্যান্ট ২ জন ছাড়াও ৮৫ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৪ জনকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স, জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর বদলি হওয়া বেশিরভাগ চিকিৎসকই ছিলেন সংযুক্তি নিয়ে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ