নিজস্ব প্রতিবেদক:
কক্সবাজার পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বইল্ল্যাপাড়া বায়তুশ শরফ রোডের মিজবা খানম। জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন বছর দশেক আগেই। সেই কার্ডের ছবি ভালো না। এই কার্ডের বদরে স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে জেনে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন হাতে কার্ডটি এলো, তখন খুশির বদলে চোখে-মুখে মিজবার বিরক্তির ছাপ।
স্মার্ট কার্ডে ভুল হয়েছে বাবার নামে। মিজবার বাবার নাম মো. আমিন আলতাজের জায়গায় স্মার্ট কার্ডে লেখা হয়েছে মো. আমিন।
কার্ডে বাবার নাম কীভাবে সংশোধন হবে, এ নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পরামর্শের জন্য ছুটেছেন মিজবা। গেছেন নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় কার্যালয়েও। কিন্তু কোনো সমাধান পাননি তিনি।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া শুরু হয়। এখন সরকারি বিভিন্ন সেবা নিতে, ব্যাংক হিসাব খুলতে এবং নানা সেবা নিতে এসব কার্ডের প্রয়োজন হচ্ছে।
তবে লেমিনেটিং করা জাতীয় পরিচয়পত্র নকল করা যেত। আবার এসব কার্ড মেশিনে পাঠযোগ্য ছিল না। এসব কারণে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর থেকে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ করা হচ্ছে যা স্মার্ট কার্ড নামে পরিচিত।
স্মার্ট কার্ডে ব্যক্তির নাম (বাংলা ও ইংরেজি), পিতা/মাতার নাম, জন্মতারিখ ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন নম্বর দৃশ্যমান রয়েছে। সব মিলিয়ে স্মার্ট কার্ডে মধ্যে থাকা চিপ বা তথ্যভান্ডারে ৩২ ধরনের তথ্য থাকবে, যা মেশিনে পাঠযোগ্য হবে।
স্মার্ট কার্ডের সঙ্গে কাগজের তৈরি ল্যামিনেট করা বিদ্যমান জাতীয় পরিচয়পত্রের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্লাস্টিকের (পলিমার দিয়ে) তৈরি কার্ডটি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। এর মেয়াদ ১০ বছর।
কার্ডের তথ্যভাণ্ডারে ব্যক্তির পেশা, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, জন্মনিবন্ধন নম্বর, লিঙ্গ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দৃশ্যমান শনাক্তকরণ চিহ্ন, ধর্ম, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, আয়কর সনদ নম্বর, টেলিফোন ও মোবাইল নম্বর, মা-বাবা ও স্বামী বা স্ত্রীর পরিচয়পত্র নম্বর, মা-বাবা বা স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য, অসমর্থ বা প্রতিবন্ধীর তথ্য ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
আয়করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর পাওয়া, শেয়ার আবেদন ও বিও হিসাব খোলা, ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন, ট্রেড লাইসেন্স করা, পাসপোর্ট করা ও নবায়ন, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, চাকরির আবেদন, বিমা স্কিমে অংশগ্রহণ, স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, নির্বাচনে ভোটার শনাক্তকরণ, ব্যাংকঋণ, গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ, সরকারি বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, টেলিফোন ও মোবাইলের সংযোগ, সরকারি ভর্তুকি, সাহায্য ও সহায়তা, ই-টিকেটিং, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, আসামি ও অপরাধী শনাক্তকরণ, বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর পাওয়া ও সিকিউরড ওয়েব লগে ইন করার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর লাগবে।
এত কাজে লাগবে যে কার্ড সেসব কার্ডে ভুল নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। তার চেয়ে বড় কথা, কীভাবে ভুল সংশোধন করা যাবে, সে বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে নাগরিকদের মধ্যে।
যেসব জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল ছিল, সেসব স্মার্ট কার্ডেও ভুল এসেছে। আবার কিছু কার্ডে ভুল এসেছে নতুন করে।
কক্সবাজারে শুধু ৮নং ওয়ার্ড নয়, এর আগে কক্সবাজার পৌরসভার যেসব ওয়ার্ডে স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোতেই ভোটারের নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম অথবা ঠিকানায় ভুল রয়েছে। কারও আগের পরিচয়পত্রেই ভুল ছিল, কারও কারও ক্ষেত্রে নতুন করে ভুল হয়েছে।
৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছালামত উল্লাহ বাবুল এ বিষয়ে বলেন, ‘যদি দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষিত স্মার্ট কার্ডে ভুল থাকে তাহলে ভোটারদের নানা হয়রানির শিকার হতে হবে। তাছাড়া সেটা কীভাবে সংশোধন করা হবে না নিয়েও সংশয় রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আগের আইডি কার্ডে যেরকম ছিল সেরকমই স্মার্ট কার্ডে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
অবশ্য স্মার্ট কার্ডে ভুল কেবল কক্সবাজারেই হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন এলাকাতে থেকেই এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিতরণ করা জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যাপক ভুল ছিল এবং সেগুলোর সংশোধন প্রক্রিয়া ছিল অনেক জটিল। স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরুর আগে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াগত জটিলতার জন্য বহু নাগরিক বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে এই সংশোধনের জন্য আবেদন করেননি।
নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কারও কার্ডে ভুল থাকলে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে গিয়ে তথ্য প্রমাণসহ আবেদন করতে হয়। আর পরে সেটি ঢাকায় আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতে হয়। আর সংশোধনের পর সেটি আবার থানা নির্বাচন অফিসে পাঠানো হবে।
তবে এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লেগে যায় এবং যাদের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে, তারা সরাসরি আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের আবেদন করতে পারবেন।
তবে এখন স্মার্টকার্ড সংশোধন আগের মতো বিনামূল্যে করা যাবে না। নির্ধারিত ফি জমা দিয়েই আবেদন করতে হবে।
সংশোধনের আবেদন যেভাবে
১) জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর নাম (বাংলা/ইংরেজি) এবং জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষেত্রে
ক. শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি/সমমান হলে এসএসসি/সমমান সনদপত্র
(খ) শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি/সমমান না হলে এবং তিনি সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত কিংবা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থায় চাকুরিরত হলে, চাকরি বই/ পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও);
(গ) পাসপোর্ট/জন্ম নিবন্ধন সনদ/ড্রাইভিং লাইসেনস/ট্রেড লাইসেন্স/কাবিননামার সত্যায়িত অনুলিপি;
(ঘ) নামের আমূল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সম্পাদিত হলফনামা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির কপি;
(ঙ) ধর্ম পরিবর্তনের কারণে নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সম্পাদিত হলফনামা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির কপি এবং আবেদনের যথার্থতা সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য দলিলাদি জমা দিতে হবে।
(২) বিবাহ বা বিবাহ বিচ্ছেদ বা অন্য কোন কারণে কোনো নারী তার নামের সাথে স্বামীর নামের অংশ (টাইটেল) সংযোজন বা বিয়োজন বা সংশোধন করতে চাইলে, তাকে কাবিননামা/তালাকনামা/মৃত্যু সনদ/ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সম্পাদিত হলফনামা/বিবাহ বিচ্ছেদ ডিক্রির সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(৩) পিতা/মাতার নাম সংশোধনের ক্ষেত্রে, জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর এসএসসি, এইচএসসি বা সমমান সনদপত্র (যদি তাতে পিতা/মাতার নাম থাকে) এবং জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর পিতা, মাতা, ভাই ও বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(৪) পিতা/মাতার নামের পূর্বে ‘মৃত’ সংযোজন বা বিয়োজন করিতে চাইলেপিতা/মাতার মৃত্যু সনদের সত্যায়িত অনুলিপি বা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি ও জীবিত থাকার সমর্থনে ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/কাউনিসলরের প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে।
(৫) ঠিকানা (বাসা/হোল্ডিং/গ্রাম/রাস্তা/ডাকঘর) সংশোধনের ক্ষেত্রে বাড়ির দলিল/টেলিফোন, গ্যাস বা পানির বিল/বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র/বাড়িভাড়া রশিদের সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(৬) রক্তের গ্রুপ সংযোজন বা সংশোধনের ক্ষেত্রে ডাক্তারি সনদপত্র জমা দিতে হইবে।
(৭) শিক্ষাগত যোগ্যতা সংশোধনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রের সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(৮) টিআইএন/ড্রাইভিং লাইসেনস নম্বর/পাসপোর্ট নম্বর সংশোধনের ক্ষেত্রে, প্রয়োজনে, টিআইএন সনদ/ড্রাইভিং লাইসেনস/পাসপোর্টের সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(৯) অন্যবিধ যে কোনো সংশোধনের ক্ষেত্রে সংশোধনের স্বপক্ষে উপযুক্ত সনদ, দলিল ইত্যাদির সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
(১০) আবেদনপত্রে জমা দেয়া নথিতে সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সত্যায়ন করতে পারবেন।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ