আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
৮০০, ৯০০ … ১০০০ … ১১০০—এভাবে নিলামে চলছে ডাক। অবশেষে ১২০০ দিনারে বিক্রি হলো। যার মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার। এই দাম কোনো গাড়ি, জমি বা আসবাবের নয়। কোনো পণ্যদ্রব্যেরও নয়। এ দাম দুটি মানুষের। এদের মধ্যে একজন নাইজেরিয়ার নাগরিক। বয়স বিশের ঘরে। পরনে মলিন জামা ও ট্রাউজার। হাঁকডাকের সময় নিলামকারী বারবার বলছিলেন, এই ছেলে ‘খেতেখামারে কাজের জন্য শক্তসমর্থ’। কে নিতে আগ্রহী।
এই দৃশ্য লিবিয়ার। কেউ মোবাইলে তা ধারণ করেছে। সিএনএন ভিডিও দেখার পর তদন্তে নামে। গোপন ক্যামেরা নিয়ে সিএনএনের একটি দল গত মাসে রাজধানী ত্রিপোলির বাইরে এক জায়গায় দেখতে পায়, নিলামের জন্য ১২ জনকে তোলা হচ্ছে। ৬ থেকে ৭ মিনিটের মধ্য তারা বিক্রি হয়ে গেল। বিক্রেতা বারবার বলছিল, ‘কারও কি খননকারী দরকার? এই যে সে একজন শক্তসমর্থ খননকারী। আমি কি দাম বলব?’
বিক্রেতা ডাক তুললেন ৫০০, ৫৫০, ৬০০, ৬৫০ …। ক্রেতারা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী হাত তুলতে শুরু করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই অসহায় মানুষগুলো নতুন মনিবের দাসে পরিণত হলো। প্রতিবছর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো অভিবাসনপ্রত্যাশী স্বপ্নের ইউরোপের উদ্দেশে লিবিয়া সীমান্ত দিয়ে ঢোকে। যুদ্ধাবস্থা থেকে বাঁচতে অথবা অর্থনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নের আশায় তারা নিজ দেশ ছাড়ে। লিবিয়ার সমুদ্র উপকূল দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয় তাদের। নিজেদের সবকিছু বিক্রি করে সমুদ্রযাত্রা করে তাদের অনেকে গন্তব্যে যেতে সক্ষম হয়। আবার অনেককেই জিম্মি করা হয়। অনেককেই বিক্রি করে দেওয়া হয় অথবা ছেড়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে।
কিন্তু সম্প্রতি লিবিয়া উপকূলে কোস্টগার্ড কড়া নজরদারি রাখছে। এতে এই উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশী বোঝাই নৌকা ভিড়তে পারছে না। তাই মানব পাচারকারীদের হাতে এখন অনেকেই জিম্মি। এই সুযোগে এই মানব পাচারকারীরা হয়ে উঠছে দাসমালিক। আর অভিবাসনপ্রত্যাশীরা পরিণত হচ্ছে দাসে। ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে আইনের শাসন তেমন করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সব সময় লেগে আছে গোলযোগ। অস্ত্রধারীরা জমি ও সম্পদের দখল নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়ছে। এই সুযোগে মানব পাচারকারী চক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এমন দুজন দাসের সঙ্গে কথা বলে সিএনএন। তখন তারা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। তারা খুব ভয় পাচ্ছিল। যে-ই তাদের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিল, তারা মনে করছিল, এই বোধ হয় আবার তাদের বিক্রি করা হবে। সিএনএন তাদের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা এই ভিডিও লিবিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারা এ ঘটনার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ত্রিপোলির ফার্স্ট লে. নাসের হাজাম অ্যান্টি-ইলিগেল ইমিগ্রেশন এজেন্সি সিএনএনকে বলেন, তিনি যদিও নিজের চোখে নিলামে দাস বিক্রির বিষয়টি দেখেননি, তবে তিনি জানতে পেরেছেন, দেশজুড়ে সংগঠিত এক চক্র পাচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় এক শহরে সাবাহতে সেনেগাল থেকে আসা এক অভিবাসী বিক্রি হয়েছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, পাচারকারীরা অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব লোকজনকে জিম্মি করে রাখত। এরপর তাদের দিয়ে পরিবারকে ফোন করিয়ে অর্থ পাঠাতে চাপ দেওয়াত। যখন তারা ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা বলত, তখন পাচারকারীরা পেছন থেকে তাদের পেটাত। ফোনে স্বজনদের কান্নার শব্দ শোনানোর জন্য তারা এমনটা করত। খুব ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হতো। তাদের অল্প একটু খাবার দেওয়া হতো। যারা মুক্তিপণ দিতে পারত না, তাদের হয় হত্যা করা হতো; না হয় ক্ষুধায় মরার জন্য ফেলে রাখত।
এমন অবস্থা থেকে মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে ফেরা সৌভাগ্যবান একজন আল-জাজিরাকে বলেন, মুক্তিপণের অর্থ জোগাড় করতে তার নয় মাস লেগেছে। এরপর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। অপুষ্টির কারণে তখন তার ওজন কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৫ কেজি। তিনি জানান, লিবিয়ার মানব পাচারকারীদের হাত থেকে রেহাই পেত না নারীরাও। তাদের কিনে বাড়িতে নিয়ে আসা হতো এবং যৌনকাজে বাধ্য করত। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) অপারেশন অ্যান্ড ইমার্জেন্সিস-বিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ আবিদকার বলেন, পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক। গত এপ্রিলে ত্রিপোলি থেকে ফেরার পর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কিছু কিছু প্রতিবেদন সত্যই ভয়ানক। এবং ‘দাস বাজার’ নিয়ে সর্বশেষ এই প্রতিবেদন অভিবাসীদের ওপর অত্যাচারের তালিকাকে আরও দীর্ঘ করল।
এই নিলাম লিবিয়ার সাধারণ শহরগুলোতেই বসে। এমন না যে সেখান সমাজজীবন অন্য রকম। আর দশটা শহরের মতো সেখানকার মানুষও নিয়মিত কাজে যাচ্ছে, শিশুরা রাস্তায় খেলছে, খাচ্ছেদাচ্ছে, বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু দাস বিক্রির বিষয়টি যেন অতীতে নিয়ে যায়, যখন একসময় বাজারে প্রকাশ্যে দাস বিক্রি হতো। পার্থক্য শুধু এখন এই ‘দাস’দের হাত ও পা শিকলে বাঁধা নেই। ত্রিপোলিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এক আশ্রয়শিবিরের সুপারভাইজর আনেজ আলাজাবি। তিনি বলেন, পাচারকারীদের হাতে অভিবাসীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অনেক ঘটনা তিনি শুনেছেন। তাদের মারধর, ছ্যাঁকা দেওয়া, এমনকি বিকলাঙ্গও করে দেওয়া হতো। তিনি বলেন, পাচারকারীদের কাছে অর্থই মূল বিষয়। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ইউরোপে পৌঁছাতে পারল, না সমুদ্রে পচে মরল, এ নিয়ে তারা তোয়াক্কা করে না।
ইউরোপে যাওয়ার আশায় ঘরছাড়া অনেক অভিবাসীর স্বপ্ন উত্তর আফ্রিকার এই রুটে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। আইওএমের হিসাবে গত তিন বছরে এ পথে গড়ে দেড় লাখ মানুষ ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। তবে এ বছর ৮ হাজার ৮০০ জনের বেশি লোক আইওএমের ব্যবস্থাপনায় নিজ দেশে ফিরে গেছে। আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই হওয়া ভিক্টোরি নামে এক যুবক বলেন, নিলামে তিনি বিক্রি হয়েছেন। নাইজেরিয়ার এদো রাজ্যে দুর্নীতির ভয়াবহতায় অতিষ্ঠ হয়ে ২১ বছরের এই যুবক বাড়ি ছাড়েন। এরপর ১ বছর ৪ মাস কেটে যায়। নিজের কাছে থাকা সব টাকাপয়সাও ফুরিয়ে যায়। তিনি ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। টাকা ফুরিয়ে গেলে ভিক্টোরিকে দিনমজুর হিসেবে বিক্রি করে দেয় পাচারকারীরা। বলে, এখান থেকে যে অর্থ আসবে, তা দিয়ে বকেয়া অনেকটা পরিশোধ হয়ে যাবে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর বলা হয়, তাঁকে বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গেছে, তা যথেষ্ট নয়। এরপর তাঁকে আবার আগের পাচারকারীর কাছে ফেরত পাঠানো হয়। এভাবে অনেকবার তিনি বিক্রি হয়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন।
ভিক্টোরি সিএনএনকে বলেন, ‘আমি লাখ লাখ নাইরা (নাইজেরিয়ার মুদ্রা) খরচ করেছি। আমার মা আমার জীবন বাঁচাতে দুটি গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অর্থ জোগাড় করেছেন।’ কথা বলতে বলতে প্রায় গলাটা ধরে আসে ভিক্টোরির। বলেন, ‘আমার বন্ধুরা ইউরোপে যেতে পারল। কিন্তু আমি শূন্য হাতে ফিরছি। তারপরও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, তারা যেতে পেরেছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ফিরে গিয়ে আমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।’
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি