নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক ৭টা। শীত তেমন একটা নেই বললেই চলে। তবে খানিকটা কুয়াশা পড়ছিল চারদিকে। এসময় বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের আশপাশের রাস্তা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়। খানিকটা সময় পরেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের মূল বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জয়নাল আবেদীন ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তখনও রাস্তায় লোকজন খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না। ভাবতেই পারেন সবাই ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্তু না, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাবেন যারা তারা কি আজ ঘুমিয়ে থাকতে পারেন? অবশ্যই না। আসলে সবাই অপেক্ষায় ছিলেন কখন উন্মুক্ত করা হবে মূল বেদী। যখনই মূল বেদী উন্মুক্ত করে দেয়া হলো নামল জনতার ঢল। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে দলে দলে লোক আসতে থাকে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। সব বয়সের, সব শ্রেণি পেশার মানুষ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
সেই স্মৃতির ভূমিতে শ্রদ্ধা জানাতে অনেকেই এসেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সকাল থেকেই মুখর হয়ে ওঠে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ।
ধানমন্ডি থেকে সাইফ নামের কলেজ শিক্ষার্থী হাতে ফুল নিয়ে এসেছেন জাতির সূর্য সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা খুবই অভাগা, আজ এখানে এসে তাদের স্মরণ করতে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের সেদিন হত্যা করা না হলে আমরা আজ কতদূর চলে যেতাম। আরও শক্তিশালী জাতি হতে পারতাম। কিন্তু তারা সেটা দেয়নি। আমরা আমাদের বিবেক তথা জ্ঞানের রত্নদের কখনো ভুলব না।’
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে নানা স্লোগান দিতে দেখা যায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষদের। এদের কারও হাতে ফুল, কারও মাথায় বা হাতে বাঁধা জাতীয় পতাকা। আবার কারও বা মুখে রং তুলির আচড়ে লেখা ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, ‘তোমাদের ভুলে গেলে চলবে না’ কিংবা ‘তোমরাই আমাদের আলো’।
১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। তারা চেয়েছিল বাঙালিকে মেধা-মননশূন্য করতে। এজন্য তারা বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পাকিস্তানি ঘাতকদের এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিল রাজাকার-আলবদর ও আল-শামস বাহিনী। বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। বিজয় অর্জনের পরে রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলা, মিরপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে একে একে পাওয়া যায় হাত-পা-চোখ বাঁধা দেশের খ্যাতিমান এই বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। হত্যার আগে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল তাঁদের ওপরে। এসব মৃতদেহ পাওয়ায় উন্মোচিত হয় ঘাতকদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। এ ঘটনায় বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল ঘাতকেরা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীনসহ নাম না জানা আরও অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী।
বাঙালি জাতি বরাবরই বিজয়ের উৎসবের আগে এই দিনটিতে শ্রদ্ধা ও বেদনার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। বিনয় ও শ্রদ্ধায় আজও জাতি সেসব বুদ্ধিজীবীকে স্মরণ করছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ