নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাদকের ‘স্বর্গরাজ্য’ এখন চট্টগ্রাম। শহরজুড়ে রয়েছে সহস্রাধিক মাদকের হাট-বাজার। সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি মাদক প্রবেশ করে রেল পথে। পাশাপাশি বিভিন্ন গাড়িতে পুলিশ ও সাংবাদিকের স্টিকার লাগিয়ে প্রতিদিন সড়ক পথেও প্রবেশ করছে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন ও মদ।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর পুরাতন রেল স্টেশন হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া। স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বরিশাল কলোনি, স্টেশন কলোনি, দারোগ হাট, মাদার বাড়ি ও কদমতলি এলাকায় মাদক এখন অবাধ। এসব এলাকায় কেবল মাদক বেঁচাকেনা নয়, মাদক সেবনের জন্য রয়েছে বিশেষ আস্তানা। যেখানে রাত দিন ইয়াবা সেবনের সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া মহানগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় রয়েছে মাদকের ছোট বড় হাট-বাজার। এমন মাদকের স্পটের সংখ্যা সহস্রাধিক। শুধু রেলযোগে প্রতিদিন নগরীতে প্রবেশ করছে কোটি টাকার মাদক। এই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত কতিপয় রেলওয়ে পুলিশ, আনসার সদস্য এবং বিভিন্ন পেশার সমন্বয়ে গঠিত দালাল চক্র।
ফেনসিডিল প্রবেশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন প্রতি বোতল হিসেবে পদ মর্যাদার ভিত্তিতে। আর অন্যান্য মাদকের টাকার ভাগ বণ্টন করা হয় মাদকের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতেও টাকার ভাগ-ভাটোয়ারার টেডিশন চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।
রেলপথ ছাড়াও চট্টগ্রামে মাদক প্রবেশের প্রধান রুট হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ইদানিং পানি পথেও ব্যাপকহারে মাদক পাচার হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সড়ক পথে মাদক প্রবেশ করে কাভার্টভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ ও বিভিন্ন মালামাল বোঝাই গাড়িতে করে। বিভিন্ন গাড়িতে ব্যবহার করা হয় পুলিশ ও সাংবাদিকের স্টিকার। সড়ক পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির দায়িত্বশীলদের মাদক ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ম্যানেজ করে নেন।
যাদেরকে ম্যানেজ করা কঠিন তাদের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য পুলিশ ও সাংবাদিকের স্টিকার লাগানো হয়। তারপরও কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সাথে সখ্যতার দোহাই দিয়ে থাকেন। এভাবেই নানা অভিনব কৌশল ব্যবহার করে প্রতিদিন চট্টগ্রামে স্রোতের মতো প্রবেশ করছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ও মদসহ নানা ধরনের মাদক।
চট্টগ্রামে রেলযোগে মাদক আসার পর মধ্য রাত থেকে শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহের কাজ। মাদক বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হয় বয়স্ক পুরুষ-নারী আর শিশুদের। যুবকদের রাখা হয় সোর্স, ইনফরমার ও বিভিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, টাকা-পয়সা বণ্টন ও হিসাব-নিকাশের কাজে।
চট্টগ্রামের ফৌজদার হাট অতিক্রম করার পর রেল থেকে মাদক খালাস শুরু হয়। নির্ধারিত স্টেশন ছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে রেল থামানো হয় মাদক নামানোর জন্য। সবচেয়ে বেশি মাদক খালাস হয় কদমতলি ও পুরনো রেল স্টেশন সংলগ্ন সিগন্যাল অফিস, কভার স্টোর ও বরিশাল কলোনির গেইট এলাকায়।
মাদক বেঁচা-কেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে শতাধিক কর্মী। তারা ডে ও নাইট দু’শিফট দায়িত্ব পালন করে। কাজের ঝুঁকির উপর নির্ভর করে কার বেতন কতো। এসব কর্মীরা বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে তোলে নিরাপত্তা বলয়। কোনো অভিযানের আলামত পরিলক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেয়া হয়। সবাই সাবধান হয়ে যায়। নিরাপদ জায়গায় মাদক সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় মাদক বিক্রেতাদের ধাওয়া ও হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাধ্য হয়ে পালাতে হয়।
বিমান ও জাহাজের মতো মিথ্যা ঘোষণা দিয়েও রেলের কার্গো করে মাদকের চালান আনা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু চালান প্রেরণ করা হয় জিআরপি থানা, রেলের নিরাপত্তা বাহিনী অথবা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামে। এভাবে নানা অভিনব পদ্ধতি ও কায়দায় মাদক ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা মাদক ব্যবসা।
পুলিশের কতিপয় সদস্য মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে বড় কোনো অভিযান চালানোর খবর আগে-ভাগে ফাঁস করে দেয়। আবার অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য স্থায়ী চুক্তির কারণে চোখে দেখেও না দেখার ভান করে অবাধ মাদক বেঁচা-কেনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনির ভূমিকার উপর নির্ভর করে মাদক বেঁচা-কেনার ধরন। সব ধরনের কম বেশি বাধা সৃষ্টি করা গেলেও মোবাইল ফোনে মাদক বেঁচা-কেনা মাদক ব্যবসায়ীরা তুলনামূলকভাবে ঝুঁকি কম মনে করে থাকে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক হচ্ছে টেকনাফ থেকে ইয়াবা আসার প্রধান রুট। টেকনাফ থেকে পানি পথেও চট্টগ্রামে নানাভাবে ইয়াবার চালান আসছে। শাহ আমানত সেতু ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন গাড়ি ও যাত্রীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে। এসব ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান এসে পৌঁছে পুরাতন রেল স্টেশন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাদকের সিন্ডিকেটের হাতে। পাশাপাশি বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও বোয়ালখালী উপজেলা থেকে আসছে চোলাই মদ। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি থেকেও চট্টগ্রামে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চোলাই মদ নিয়ে আসছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, নানা ভাবে যাচাই-বাছাই করে চট্টগ্রামে পাঁচটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিষয়গুলো হল— মাদক, জাল-জালিয়াতি, চোরা চক্র, সন্ত্রাস ও অস্ত্র। এ ব্যাপারে আমরা নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। কোন অপরাধ কিভাবে এবং কাদের পৃষ্টপোষকতায় হচ্ছে এসব যাবতীয় খোঁজ-খবর আমরা নিয়েছি। বিগত কয়েক মাসে মাদক-বিরোধী অভিযানে আমরা বেশ সাফল্য অর্জন করেছি। এ ক্ষেত্রে থানা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, র্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা এবং সামাজিক আন্দোলন দরকার।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের অসংখ্য মাদকের আখড়া গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামের সকল মাদকের আখড়া গুড়িয়ে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে নেয়া হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের কয়েকজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ