নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পরও দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। এমনকি তিনি হাসপাতালের একটি ইউনিটও পরিচালনা করছেন।
যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) মো. সিরাজুল হক খান ৪ মে তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়েছে ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের বিরুদ্ধে ‘ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’ শিরোনামে ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর সংবাদ প্রকাশিত হয়।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, রোগী চামেলী দাসের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি (রিং পরানো) করার আগে রোগের লক্ষণ ও রিপোর্ট পর্যালোচনা করে একটি সঠিক ডায়াগনোসিসে উপনীত হওয়া উচিত ছিল।
একই সঙ্গে সিজিএ ও স্টান্টিং করার আগে চিকিৎসার ঝুঁকি সম্পর্কে রোগী/রোগীর অভিভাবককে অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর ১১(১) বিধি মোতাবেক চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হল।
একই তারিখে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ মোতাবেক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে মন্ত্রণালয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার রোগী চামেলী দাসের সঠিক ডায়াগনোসিসে উপনীত না হয়ে এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি করেন। রোগীকে যথাযথ পর্যবেক্ষণ না করার ফলে রোগী মৃত্যুবরণ করেন।
এমনকি এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে ওই চিকিৎসক স্টান্টিং করার আগে চিকিৎসা ঝুঁকি সম্পর্কে রোগী/রোগীর অভিভাবককে অবহিত করেননি- এটাও প্রমাণিত হয়েছে। এসব কার্যক্রম দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। যা সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ মোতাবেক অসদাচরণ হিসেবে গণ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কোনো সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হলে তিনি কোনোভাবেই নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মচারীকে সব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
হৃদরোগ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৪ মে ডা. প্রদীপকে বরখাস্ত করা হলেও তিনি নিয়মিত হাসপাতালে আসছেন এবং তার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিয়মিত রোগীও দেখছেন। এমনকি তিনি তার নিয়ন্ত্রণাধীন হাসপাতালে কার্ডিওলজি বিভাগের ১১ নম্বর ইউনিট পরিচালনা করছেন ও রোগী ভর্তি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, ডা. প্রদীপ সরকারি নির্দেশ অমান্য করে আরও একটি অপরাধ করছেন। তাছাড়া তিনি সরকারি আদেশের বিপরীতে একজন উকিলের সার্টিফিকেট হাসপাতাল প্রশাসনে দাখিল করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে এ চিকিৎসককে শাস্তিমূলক বদলি করা হলে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করে বদলি আদেশের বিপরীতে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ নেন। ডা. প্রদীপ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) মো. হাবিবুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, সরকারিভাবে কোনো কর্মচারী দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরখাস্ত হওয়ার পর কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। তাকে সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ধরনের কার্যক্রম সরকারি আদেশের সুস্পষ্ট লংঘন।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পিএলআরে যাওয়া কর্মচারী বজেন্দ্র চন্দ্র দাশ তার স্ত্রী চামেলী দাসের হার্টে সমস্যা হলে গত বছরের ১৫ নভেম্বর হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি করান।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার রোগীকে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। সেই মতো ২১ নভেম্বর বেলা ১টায় রোগীকে এনজিওগ্রাম করা হয় ও রিং পরানো হয়।
রাত ৮টায় রোগীর মৃত্যু হয়। এনজিওগ্রাম করার সময় রোগীর হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম থাকার পরও রিং পরানোর জন্যই তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মৃতের স্বামী বজেন্দ্র চন্দ্র দাশ।
বিষয়টি হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. এসটিএম আবু আজমকে জানানো হলে তিনি রোগীর চিকিৎসার বিভিন্ন ধাপ পরীক্ষা করেন। এ সময় অনেক কম হৃৎস্পন্দন থাকার পরও রিং পরানোর ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ ঘটনায় চিকিৎসকের অজ্ঞতা ও অবহেলার অভিযোগ উঠলে ২৩ নভেম্বর হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক আবু আজম হাসপাতালের কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. আফজালুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে তাকে বদলি করা হয়। পরে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ