২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:৩১

শূন্য রেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে অনিহা

কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :

মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও রাখাইন সশস্ত্র জনগোষ্টির নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সেখান থেকে স্থানান্তরে হতে অনিহা প্রকাশ করেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পার্বত্য জেলাসহ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের পর্যায়ক্রমে কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হবে। যার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বান্দরবান জেলা প্রশাসন ঘুমধুম বাগানপাড়া ও জিরো পয়েন্টের তুমব্রু পশ্চিমকূলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কুতুপালং এবং বালূখালীতে স্থানান্তর করেছে। এদিকে দেখা গেছে, সীমান্ত পাড়িয়ে দিয়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে এসেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। এরপর তাদের আশ্রয় হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে। তবে বান্দরবানের তমব্রু ও চাকঢালা সীমান্ত দিয়েও অনেকে এসেছেন। তারা আশ্রয় নিয়েছেন সেখানেই। নিজের দেশ, ঘরবাড়ি ফেলে আসা এসব মানুষ এখনো নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার দীর্ঘ যাত্রার মানসিক বিপর্যস্ততাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদেই বসতি গড়তে হয়েছে তাদের। নাইক্ষ্যংছড়িতে থাকা রোহিঙ্গাদের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু তুমব্রু কোনারপাড়া শূন্য রেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গা কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে যেতে অনিহা। রোহিঙ্গারা বলছেন, বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমার বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাদের। রাখাইনে থাকতেও তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। তার ওপর বাংলাদেশে আসার সময় পাহাড়, নদী, জঙ্গল পার হতে হয়েছে। কয়েকদিন ধরে পায়ে হেঁটে যখন বাংলাদেশে তারা পৌঁছেছেন,তখন তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে হাঁটা-চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এখানে আসার পর অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ যাত্রার শারীরিক-মানসিক চাপ তারা এখনও কাটিয়ে উঠলেও অন্যত্রে বসবাসের স্থান নিশ্চিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে থাকতে চান। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, ২৫ আগষ্টের পরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু পশ্চিমকূলে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। ওই সময় নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চাকঢালা সীমান্তে আশ্রয় নেয় আরো প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা। তবে ইতোমধ্যে তুমব্রু পশ্চিমকূলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জেলা প্রশাসন উখিয়ার কুতুপালং ও বালূখালীতে স্থানান্তর করলেও চাকঢালায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখনো রয়ে গেছে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে। এছাড়াও তুমব্রু কোনারপাড়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে চলে গেলেও এখনো শূন্য রেখায় প্রায় ৫শতাধিক পরিবারের আড়াই হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। সীমান্তের শূন্য রেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট এলাকার মাস্টার দিল মোহাম্মদ জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গেছে। কুতুপালং বা বালুখালীতে নিয়ে গেলে আবার তাদের নতুন করে পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে বসবাস শুরু করতে হবে। সেখানকার পরিবেশে নতুন করে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন তিনি। সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট পশ্চিমকূলে গ্রামে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মাহমুদা খাতুন বলেন, ‘আমরা এখানেই ভালো আছি। আমরা কুতুপালংয়ে যেতে চাই না। মিয়ানমারে এখনো অনেক রোহিঙ্গা আছে, তারাও এখানে এসে আশ্রয় নেবে। নতুন যারা আসবে, সরকার তাদের কুতুপালং বা বালুখালীতে নিয়ে গেলেই ভালো হবে।’ মাহমুদা খাতুনের পাশেই ছিলেন মোহাম্মদ নুরু। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে ভালোভাবে থাকতে পারছি, খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি। আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না এখানে। তাই এখানেই আমরা থাকতে চাই। অন্য কোথাও যেতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকদিন হেঁটে বাংলাদেশে এসেছি। হাঁটাতে হাঁটতে আমাদের পায়ের নিচে চামড়া ফেঁটে গেছে। এখানে কয়েকদিন থাকার পর এখন একটু একটু করে পা ভালো হচ্ছে। এখন আমরা কেউ অন্য কোথাও যেতে চাই না।’ আরেক রোহিঙ্গা আহমদ কবির বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে আসতে আসতে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবাই অসুস্থ। এ অবস্থায় তাদের কুতুপালং বা বালূখালীতে নিয়ে যাওয়াটাই কঠিন হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসার পর আমরা অনেক কষ্ট করে ঘরগুলো তৈরি করেছি। এখন এগুলো ফেলে যেতেও তো খারাপ লাগবে।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। সীমান্তের তুমব্রু এলাকার ছৈয়দ আহমদ জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু কোনারপাড়া শূন্য রেখায় রোহিঙ্গারা ৩মাস ধরে অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা নেতারা ত্রান বাণিজ্য সহ বিভিন্ন ফায়দা লুটছে। যার ফলে তাদেরকে শূন্য রেখা থেকে অন্যত্রে না সরতে এসব দালালেরা রোহিঙ্গাদের গোপনে উস্কানি দিচ্ছে। এছাড়াও রাতের আধারে এসব রোহিঙ্গা বস্তিতে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে। বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব রোহিঙ্গারা এসেছেন, তাদের জন্য সরকার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালীতে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে। যতদিন পর্যন্ত তারা নিজ দেশে ফিরে না যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। তার অংশ হিসেবে নাইক্ষ্যংছড়িতে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদেরও পর্যায়ক্রমে কুতুপালংয়ে স্থানান্তর করা হবে।’ জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ‘বর্তমানে যেসব রোহিঙ্গারা শূন্য রেখায় অবস্থান করছেন। তারা সেখানে নিরাপদ নয়। যে কোনো মুহূর্তে মিয়ানমারের হামলার ঝুঁকি আছে। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :ডিসেম্বর ৩, ২০১৭ ৫:৫০ অপরাহ্ণ