নিজস্ব প্রতিবেদক:
সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর যানজট স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। সীমিত সড়কে কত যানবাহন চলাচল করবে তারও বাস্তবসম্মত কোনো নির্দেশনা নেই। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দেদারসে চলছে ব্যবসা বাণিজ্য। সর্বোপরি ট্রাফিক আইন প্রয়োগে দৃশ্যত শীতল ও অনেক ক্ষেত্রে সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নগরীর যানজট বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অপরিকল্পিত বাস স্ট্যান্ডের কারণে নগরীর চার প্রবেশমুখ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ট্রাফিক বিভাগের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় হাটহাজারি সড়ক থেকে ঢুকতে নগরীর অক্সিজেন মোড়, দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে শাহ আমানত সেতু, কাপ্তাই থেকে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা এবং সারাদেশের সাথে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সিটি গেট-কর্ণেল হাটের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নগরীতে আসা যাওয়া করতে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে শাহ আমানত সড়ক, কালুরঘাট সড়ক, বাদুরতলা (আরাকান) সড়ক এবং মুরাদপুর সিডিএ এভেনিউ মোট চারটি অন্যতম প্রধান সড়কের সংযোগস্থল বহদ্দারহাট মোড় থেকে মুরাদপুর মোড় পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, রড-সিমেন্ট, কাঠসহ বিভিন্ন দোকানপাঠ। বহদ্দারহাট থেকে রাহাত্তারপুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকশ গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ।
কালুরঘাট ও পুরো আরাকান সড়কের দু’পাশ সিএনজি ট্যাক্সির গ্যারেজ ওয়ার্কশপ এবং কাঠের দোকান রয়েছে সহস্রাধিক। পাশাপাশি রয়েছে মাইক্রো, ট্যাক্সি ও রিক্সা-ভ্যানর অবৈধ স্ট্যান্ড। এসবের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনা যোগ হয়ে বহদ্দারহাট মোড়ে সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজ করে দু:সহ পরিবেশ। মুরাদপুর মোড় থেকে পশ্চিম ষোলশহর রেল স্টেশন, পূর্বে শুলকবহর, উত্তরে বিবিরহাট এবং দক্ষিণে মির্জাপুল পর্যন্ত রোডে মাইক্রো, ট্যাক্সি ও রিক্সার অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে এসব এলাকায় দীর্ঘ যানজটে পড়ে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নগরীর ব্যস্তম মোড় হওয়া সত্ত্বেও জিইসি মোড় সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে প্রতিনিয়ত রিক্সা ও ট্যাক্সির জটলা লেগে থাকে। মোড়ে নির্ধারিত স্থান ব্যবহার না করে যত্রতত্র যানবাহন দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী উঠানামা করানোর কারণে পুরো মোড়েই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। জিইসি মোড়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের চিহ্ন না থাকায় পথচারীরা এলোমেলোভাবে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। তাতে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। চকবাজার ধুনিরপোল থেকে শুরু করে পূর্ব বাকলিয়া কর্ণফুলী নদীর তীর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে এবং চকবাজার থেকে শুরু করে ঘাসিয়াপাড়া পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম পাশে অবৈধ দোকানের সারি। রাহাত্তার পুল পর্যন্ত এলাকার দোকানগুলোর মালামাল রাস্তাকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে ফেলছে। উল্লেখিত সড়কগুলোতে ভ্যান, ঠেলাগাড়িতে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো ব্যস্ত এ সড়কের দুর্দশার একটি বড় কারণ।
ব্যতিক্রমধর্মী কারণে যানজট হচ্ছে আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে। রাস্তা দখল করে গাড়ির যন্ত্রাংশ মেরামত ও গাড়ির সাজসজ্জার কাজ করে সড়কের দু’পাশে অবস্থিত শতাধিক মোটর পার্টস দোকানের কারিগররা। গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীদের খেসারত দিতে হচ্ছে সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদেরকে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কোনো অভিযান চলতে দেখা যায়নি। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী আছদগঞ্জে যানজট নিত্য ঘটনা। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট লেগেই থাকে। রাস্তার পাশে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি রাখা, রাস্তার উপর ট্রাক দাঁড় করিয়ে পণ্য ওঠানামা এবং সরু সড়কের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়।
সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়ার মতে, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন যানজটের অন্যতম কারণ। সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই, নেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আগামী কয়েক দশককে সামনে রেখে পরিকল্পনার কোনো মানসিকতাই এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে গড়ে উঠেনি। যানজট নিরসনে নগরীতে বড় বাসের মতো গণপরিবহণের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পৃথক লেন। প্রয়োজনে ডাবল ডেকার প্রচলন করা যায়। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ট্যাক্সি, কারের মতো ছোট যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে। নগরীর প্রবেশ মুখসহ প্রতিটি এলাকার টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড হতে হবে বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনা ও ডিজাইনের ভিত্তিতে।’
যাত্রী স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘যানজট নিরসন কিংবা পরিবহণ ব্যবস্থায় অনিয়মের কথা উঠলেই ট্রাফিক বিভাগ কিংবা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জনবল স্বল্পতার অজুহাত দেখান। সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ যদি বিদ্যমান জনবল নিয়েই আন্তরিকভাবে কাজ করেন এবং আইনের সঠিক ব্যবহার থাকলে নগরীর চিত্র পাল্টে যেতে বাধ্য। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থাকে অনেক সময় পরিবহণ মালিক শ্রমিকদের সাথে সমঝোতা করে কাজ করতে দেখা গেছে। ট্রাফিক বিভাগ এবং পরিবহণ নেতাদের সমন্বয়ে চলছে টোকেন বাণিজ্য। এছাড়াও চলছে অভিনব কৌশলে চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তির কারণে অবৈধ গাড়ি এবং গাড়ির মালিক, চালক ও শ্রমিকের প্রকাশ্য নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেই।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘নগরীতে যানবাহনের সংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় সড়ক বাড়েনি। বাড়েনি যানবাহন চালকদের সচেতনতা। নগরীতে এখনো পরিকল্পিতভাবে বাস ও ট্রাক টার্মিনাল গড়ে উঠেনি। প্রতিদিন নগরীতে ১০ হাজারের অধিক ট্রাক চলাচল করলেও লোকাল ট্রাকের জন্য কোন টার্মিনাল নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে কন্টেইনারবাহী ট্রেইলরের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীর যানজট নিরসন সম্ভব নয়।’
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ