নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্ত্রী বায়না ধরেছে পুঁটি মাছ খাবে। তাই বুধবার ভোরে চোখ কচলাতে কচলাতে ব্যাগ হাতে রাসেদ ব্যাপারী হাজির মংলা শহরের মাছ বাজারে।বাজারে দুই কদম ঢুকতেই মিলল ছোট্ট পুঁটিমাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কেজি ১৮০।রাসেদ আরেকটু সস্তার আশায় বাজারের ভিতরে গেলেন। পেয়েও গেছেন তুলনামূলক বড় সাইজের পুঁটি। ডালায় সাজিয়ে রেখেছেন এক যুবক বিক্রেতা।
দাম হাঁকালেন ৩০০ টাকা। ১৮০-৩০০ টাকা দামের পার্থক্য জানতে চাইলে বিক্রেতার গম্ভীর গলায় উত্তর, ‘ওটা বিষ খাওয়া মাছ। নদীতে বিষ দিয়ে যে মাছ ধরে সেই মাছ। কাঁকড়া ধরার জন্য মানুষ নেয়। অনেকে সস্তা পেয়ে খায়।’
বিক্রেতার কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাসেদ ব্যাপরী ব্যাগ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা দরে এক কেজি পুঁটি মাছ কিনলেন তার ভালবাসার মানুষটির জন্য। আর রসিকতা করে গাইলেন, ‘ওগো শুনছো তোমার পুঁটি মাছ বিষ খেয়েছে। আর আমার কেটেছে পকেট।’ রসিদ ব্যাপারীর স্বরচিত গান এখানে থেমে গেছে। কিন্তু থামেনি অসাধু জেলেদের গল্প। যারা একটু লাভের আশায় বিষাক্ত করে তুলছে মানবদেহ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘বিষাক্ত হয়ে উঠছে সুন্দরবনের নদ-নদী, খাল। প্রকাশ্যেই চলছে বিষ দিয়ে মাছ নিধন। একশ্রেণীর অসাধু জেলেরা এসব নদী-খালে মাছ ধরতে গিয়ে প্রায় সব জলজ প্রাণী মেরে ফেলছেন। কারণ জাল দিয়ে মাছ ধরার বদলে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট থাকায় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরও এ অপরাধ থামানো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন পরিবেশবিদরা।
সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল জলভাগ। সুন্দরবনসহ এখানকার অসংখ্য খালে আছে তিন শতাধিক প্রজাতির মাছ। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বন বিভাগ থেকে পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনের অভ্যন্তরের চারটি রেঞ্জের আওতাধীন ১৮টি খালে জেলেদের প্রবেশ ও মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এসব খালে মা-মাছ ডিম ছাড়তে আসে।
বন বিভাগ অফিস সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে নিষিদ্ধ খালে মাছ শিকারের অপরাধে ৪০টির মতো মামলা হয়েছে। চলতি বছরের জুনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় চার জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। গত অক্টোবরের প্রথম দিকে মরাপশুর অফিস সংলগ্ন খাল থেকে সাত জেলেকে বন বিভাগ আটক করে জেলে পাঠায়। ১ নভেম্বর সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের নিষিদ্ধ আন্ধারিয়া খালে জেলেদের পাঁচটি নৌকা আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন রেঞ্জ কর্মকর্তারা। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় রেঞ্জের স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামানসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
মংলার জয়মনি গ্রামের আনন্দ মন্ডল, গোবিন্দ রায় রায়, কাদের ইসলাম, বেলায়েতসহ কয়েকজন জেলে জানান, কিছু জেলে বেশি লাভের আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে। ঢাংমারী, মরাপশুর, জোংড়া, জাপসিসহ সুন্দরবনের অনেক ক্যাম্প অফিসের বনকর্মীরা এর সঙ্গে জড়িত।
বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বিষ প্রয়োগ শুধু সুন্দরবনের জলাশয়কেই বিষাক্ত করছে না, বিষাক্ত যে মাছ আমরা খাচ্ছি, তা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি বন্ধ করা খুবই জরুরি।
এ ব্যাপারে মংলা উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিষ প্রয়োগের ফলে বিষাক্ত পানি সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল থেকে ভাটার সময় নদীতে নেমে আসে। এ কারণে জলজ প্রাণিসহ বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রজাতির আর ছোট-বড় মাছ এখন নদীতে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আইনশৃঙ্খলা সভায় একাধিকবার প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার অনুরোধ করেছি।
মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শুদিপ বালা জানান, এই বিষাক্ত পানির মাছ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিষাক্ত পানির মাছ খেলে মানুষের কিডনি ও লিভারে জটিলতা দেখা দেয়। তাই বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জানতে চাইলে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মংলা সদর দপ্তর) অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কোস্টগার্ড। একইসঙ্গে জেলেদের যেসব মহাজন বিষ দিয়ে বনের খালে পাঠাচ্ছেন, তাদেরকেও চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ