২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:৩০

পিলখানা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় (বিডিআর হত্যা মামলা হিসেবে পরিচিত) হাইকোর্টের রায় প্রদান শুরু হয়েছে। আজ সোমবার এ রায়ের মূল অংশ ঘোষণা করা হবে। আজ কার কোন মেয়াদে সাজা হচ্ছে, কারা খালাস পাচ্ছেন-এসব বিষয়ে জানা যাবে। বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চ এ রায় দিচ্ছেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

প্রথম দিন রায়ের পর্যবেক্ষণে পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে একটি নজিরবিহীন ঘটনা উল্লেখ করে বিচারপতিরা বলেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়নি। এত অল্প সময়ে এক সঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।’ বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি মো. শওকত হোসেন গতকাল সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু করেন। তার অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেয়া শুরু করেন। রোববার বিকেল পর্যন্ত তিনিই পর্যবেক্ষণ দেন।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ওইদিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এমনকি বিডিআর (বিজিবি) মহাপরিচালকের স্ত্রীকেও হত্যা করা হয় নৃসংশভাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়নি। এটা ছিল নির্বিচারে হত্যা (মাস কিলিং)। ওইদিন দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করা হয়। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের জন্য এটা একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলার বিচারকালে বেশ কিছু আইনগত প্রশ্ন ওঠে। আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর বিচার শুরু হয়। এ মামলাটিতে আমরা ৩শ ৭০ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেছি। ৮শ ৫০ জন আসামির মধ্যে পলাতক ছাড়া বাকিরা এ রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। পাশাপাশি দেশের অনেকেই এ রায় জানতে চান। কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটাবে। তাই আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটা অনেক বড় রায়। আমরা একটা ভাল রায় দেয়ার চেষ্টা করছি। তাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। রায়ে আমাদের আলাদা আলাদা পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে। তবে রায়টি হবে সর্বসম্মতভাবে। রায়ের আদেশের অংশের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বলেছেন, ‘এত অল্প সময়ে এক সঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মোট ৫৫জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল।’
পর্যবেক্ষণে তিনি আরও বলেছেন, ‘আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে ১৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার নজির আছে। দক্ষিণ ফিলিপাইনের এক বিদ্রোহে ৬ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে ১৯৬৭ সালে চিনপন্থী কমিউনিস্টদের সমর্থনে সংঘটিত ৭ দিনের বিদ্রোহে ১০০ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। আর পিলখানার ঘটনা তাকেও হার মানায়। ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ ঘন্টার বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনা ছিল অবর্ননীয় বর্বরোচিত এবং নজিরবিহীন।’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতর পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরী এ বাহিনীর নাম ২০১০ সালে পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পরিচিত। এ বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে।
হত্যা মামলায় মোট আসামি ছিল ৮৫০ জন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৭ জন।
নিয়ম অনুযায়ী রায় ঘোষণার কয়েক দিন পরেই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মৃত্যু অনুমোদনের জন্য মামলাটি ‘ডেথরেফারেন্স’ হিসেবে হাইকোর্টে আসে। এছাড়া আসামিরা আপিল করেন। পাশাপাশি খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৭৯ জনের শাস্তি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসব আপিল ও ডেথরেফারেন্সের ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিশেষ বেঞ্চ গঠন হয়। এরপর একই বছরের ১৭ জানুয়ারি এই বেঞ্চ পুনর্গঠন হয়। পুন:র্গঠিত এই বেঞ্চে একই বছরের ১৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপরে পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু হয়। গত ১৩ এপ্রিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :নভেম্বর ২৭, ২০১৭ ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ