২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:০৮

গলদা নিয়ে বিপাকে চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সাদা সোনা খ্যাত গলদা চিংড়ির রপ্তানি চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকেই নিম্নমুখী। সে জন্য গত সেপ্টেম্বরে স্থানীয় বাজারে গলদা চিংড়ির দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যায়। গত কয়েক দিনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও চাষিদের উৎপাদন খরচই উঠছে না। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা। চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রপ্তানি হওয়া গলদা চিংড়ির ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাজ্য। তবে ব্রেক্সিটের কারণে দেশটিতে এখন মন্দাবস্থা চলছে। তাই চিংড়ির চাহিদাও গেছে কমে। তবে দেশে প্রতিবছরই গলদার উৎপাদন বাড়ছে। একদিকে রপ্তানিতে মন্দা অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি—তার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। কমছে দাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে চাষিরা গলদা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
বাগেরহাটের বিভিন্ন আড়তে গতকাল মঙ্গলবার বড় আকারের বা ৫ গ্রেডের প্রতি কেজি গলদা ৭৪০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়। পাঁচ মাস আগে এ দাম ছিল ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা। ছোট আকারের বা ১০ গ্রেডের গলদা ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ মাস এই গ্রেডের দাম ছিল ৯৫০ টাকা। এ ছাড়া ২০ ও ৩০ গ্রেডের বা সবচেয়ে ছোট আকারের গলদা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকার মধ্যে। লবণ পানির বাগদার চেয়ে মিষ্টি পানির গলদা চাষে ঝুঁকি কম। তাই প্রতিবছরই গলদার উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৪২ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। আর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ৪৮ হাজার ৫৭৪ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের উৎকুল গ্রামের মোল্লা মারুফুল হক ছয় বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছেন। চলতি বছর তিনটি ঘেরে মোট চার বিঘা জমিতে গলদা চাষ করেছেন তিনি। মারুফুল বলেন, ‘চাষিরা সব দিক থেকেই বিপদে। ঘেরে আমরা যে রেণু ছাড়ি, দেখা যায় হাজারে ৫০০ থেকে ৬০০টা বাঁচে। খাবার ও শ্রমিকের মজুরি—সবকিছুর দামই বেশি। কিন্তু চিংড়ি বিক্রি করতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। ডিপো মালিক বা ফ্যাক্টরিগুলো ঠিকই লাভ করছে। আমরা চাষিরা মরছি।’ বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর মৎস্য আড়তে চিংড়ি বিক্রি করতে আসা রামপাল উপজেলার উজলকুড় ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের চাষি দীপঙ্কর বাড়ৈ বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ৯ বিঘা জমিতে চিংড়ির চাষ করি। মৌসুমের শুরুতে ঘেরে রেণু পোনা ছেড়ে ভাইরাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। পরে আবারও নতুন করে পোনা ছেড়ে চাষ শুরু করি। কিন্তু বিক্রির সময় এলেই বাজার পড়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, বাজারের অবস্থা খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন তাঁদের অবস্থা বেশি খারাপ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। সামগ্রিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি বাড়লেও যুক্তরাজ্যে কমেছে। গত অর্থবছর দেশটিতে ৮ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের চিংড়ি। গলদা রপ্তানির ৬৫-৭০ শতাংশই যুক্তরাজ্যে যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যুক্তরাজ্যের খাবারের দোকানগুলোতে গলদার চাহিদা কমে গেছে। তাতে ক্রয়াদেশ কমেছে প্রায় অর্ধেক। তিনি আরও বলেন, ‘গলদা চাষে খাবার বেশি লাগে, তাই খরচও বেশি। কিন্তু বিক্রি করে যদি উৎপাদন খরচই পাওয়া না যায়, তাহলে চাষিরা উৎপাদন থেকে সরে আসতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত।’
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকেরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই বাজার হঠাৎ হঠাৎ ফেলে দেন। চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন—এমন অভিযোগ করেন বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম। এ বিষয়ে কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘গতবারের চেয়ে এবার প্রতি পাউন্ড বাগদা চিংড়ি রপ্তানিতে ১ ডলার বেশি মিলছে। সে জন্য আমরাও স্থানীয় বাজার থেকে বেশি দামে বাগদা কিনছি। তবে গলদার রপ্তানি কমে যাওয়ায় দামও কমেছে।’ মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেখানকার ক্রেতারা খরচ কমাতে ছোট আকারের চিংড়ি কিনছেন। কিন্তু আমাদের চাষিরা বড় আকারের চিংড়ি উৎপাদনেই বেশি মনোযোগী। চাষিরা যদি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী চিংড়ি উৎপাদন করতেন, তাহলে পরিস্থিতি হয়তো এতটা খারাপ হতো না।’

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :নভেম্বর ২২, ২০১৭ ৫:১৫ অপরাহ্ণ