দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:
সৌদি বাদশাহ্ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের নিরব সমর্থনের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশের ভেতরে এবং বাইরে তিনি যেসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন তাতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারও কারও মতে, বত্রিশ বছর বয়সী সালমানের কারণে এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে একাধিক যুবরাজ এবং দু’শতাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে আটক করা তো আছেই, লেবানন এবং ইয়েমেনের শীর্ষ নেতাদের অবরুদ্ধ করে রাখার পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব যেভাবে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে তাতে এই অঞ্চলে নতুন শঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন অনেকে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের অধ্যাপক স্টিফেন হার্টগ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারে সৌদি আরবের এসব উদ্যোগ ওই অঞ্চলের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তিনি বলছেন, ইরানের সমর্থন পুষ্ট লেবাননের প্রভাবশালী সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের দ্বারা যে কোনো সময় শঙ্কটে পড়তে পারে সৌদি রাজবংশ। এই শঙ্কটের পেছনে সৌদি রাজপরিবারের সুবিধা বঞ্চিতরাও মদদ দিতে পারেন। সৌদি আরবের বিষয়ে তার মিত্র দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রও এখন চিন্তিত। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাগত জানালেও এখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। সালমানের এসব উদ্যোগ ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে’ বলেও ওয়াশিংটন এখন মনে করছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের বরাতে আলজাজিরা জানায়, পেন্টাগন ও গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মার্কিন কূটনীতিকদের মনোভাবও এখন প্রায় একই। নিউইয়র্ক টাইমসকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক কর্মকর্তা জানান, ক্রাউন প্রিন্স সালমান যা করছেন তা বুঝে করছেন বলে মনে হচ্ছে না। এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের পরিণতির ব্যাপারে সম্ভবত তার কোনো ধারণাই নেই। ক্রাউন প্রিন্স সালমানকে তার বাবা কিং সালমান গত জুনে ক্ষমতার পরবর্তী উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেন ক্রাউন প্রিন্স। সৌদি আরবংশের প্রভাবশালী যুবরাজদের তো সালমান আটক করেছেনই, পাশাপাশি অপঘাতে দু’জন সৌদি প্রিন্সের মৃত্যুর খবর নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ‘অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম’ এর নামে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো। তবে এই যুদ্ধে সাফল্যের সম্ভাবনা তো দেখাই যায়নি, উল্টো খোদ সৌদি ভূখণ্ডই একাধিকবার হামলার হুমকিতে পড়েছে। কিন্তু এর আগে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচারা দিয়ে উঠলেও এর আঁচ কখনও সৌদি আরবে লাগেনি। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় মার্কিন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার করলেও ইরান একমাত্র দেশ যাকে কখনওই দমানো সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থায় সৌদি যুবরাজ সালমানের ইরান বিরোধী কর্মকাণ্ড ভয়ানক বার্তা বহন করছে বলে বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন।
যুবরাজ সালমানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এরই মধ্য ঘটে গেছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর লেবানন নিয়ে একই ধরনের সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে সৌদি আরব। ইসরাইলের সমর্থন নিয়ে সুন্নি বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার সালমানের পরিকল্পনা কার্যত ভেস্তেই যেতে বসেছে। উল্টো সৌদি আরবের আগ্রাসী নীতি ওই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ও শক্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে পট পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে যুদ্ধ আর প্রাণহানির পর ইরাকে এখন শিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইরাকের নেতৃত্বে থাকা শিয়া ধর্মীয় নেতারা ছাড়াও দেশটির প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি ইরানপন্থী হিসেবেই পরিচিত। তবে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমান সম্পর্ক বজায় রেখে চলা ইরাক’ই মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ বলে বিশ্লেষকেরা মনে করে থাকেন। কিন্তু সৌদি আরবের সাথে রয়েছে ইরাকের ৮শ’ কিলোমিটার সীমান্ত। ফলে ইয়েমেন, কাতার কিংবা লেবাননে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও ইরাকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবকে সবসময়ই চরম উৎকণ্ঠায় থাকতে হবে। বেশ কিছু দিন থেকে তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরবকে একটি মধ্যপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণায় সরাসরি সমালোচনা করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগান। তিনি বলেছেন, ইসলামের পরিচয় ইসলাম! একে মধ্যপন্থী বা উদার বলার কোনো প্রয়োজন নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমানে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে চলে এসেছে তুরস্ক। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের পর দেশটির পাশে তুরস্কই প্রথম দাঁড়িয়েছে। কাতারের নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় নিয়ে দেশটির আমিরের আহ্বানে সামরিক ঘাঁটি পর্যন্ত স্থাপন করেছে তুরস্ক। প্রায় ২০ হাজার তুর্কি সৈন্য এখন কাতারে অবস্থান করছে। এমন অবস্থায় সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইসরাইল ও সৌদি আরব। সম্প্রতি ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাঁস হওয়া কিছু তারবার্তার মাধ্যমে জানা গেছে, তেলআবিব তাদের কূটনীতিকদের নির্দেশ দিয়েছে যে সৌদি আরবকে যেন সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রভাব বিস্তার করে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, তা সম্ভব নয়। উল্টো সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সামনের দিনগুলো সৌদি আরবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলেই মনে হচ্ছে। এমন অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের ভবিষ্যত নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি