আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের সময় ক্যাথলিক চার্চপ্রধান পোপ ফ্রান্সিস যেন ‘রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা’র খাতিরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করেন, সে জন্য তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি এর আগে পোপ ‘রোহিঙ্গা ভাই-বোন’ শব্দটি ব্যবহার করে তাদের প্রতি সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
ক্যাথলিক চার্চ ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তির পোপকে এ ধরনের পরামর্শের বিরোধিতা করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা; যারা এরই মধ্যে ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এই দেশহীন জনগোষ্ঠীকে’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘রোহিঙ্গা’ বলেই অভিহিত করে আসছে।
চলতি বছরের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা সৃষ্টির পর সেখান থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদি উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পরিহার করার পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীকে নিজেদের দেশের নাগরিক বা স্বতন্ত্র নৃগোষ্ঠী বলেও স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঁচ দিনের সফরে পোপ ফ্রান্সিস ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশে আসবেন। পরে তিনি মিয়ানমার যাবেন। ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সেখানে থাকবেন। রাখাইনের সহিংসতা নিরসনে মিয়ানমার সরকার গঠিত কমিশনের প্রধান ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ও মিয়ানমারের কার্ডিনাল চার্লস মং বো আশা করেন যে, পোপ তাঁর সফরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করবেন না। খ্রিস্টানরাও মিয়ানমারে সংখ্যালঘু।
পোপকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ‘রোহিঙ্গা’র পরিবর্তে ‘রাখাইন রাজ্যের মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য। যদিও গত অক্টোবরে সহিংসতা শুরু পর এক বিবৃতিতে ‘রাখাইনের রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে’র জন্য মিয়ানমার সরকারের আহ্বান জানিয়েছিলেন পোপ। এ সময় তিনি ‘তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস’ রক্ষার কথাও বলেন।
কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের প্রতিবেদন মিয়ানমার সরকারের কাছে দাখিল করার পর পরই রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানকার ৩০টি সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়, যার জন্য দায়ী করা হয় রাখাইন রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (অরসা) নামে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের একটি সংগঠনকে। যার জের ধরে সেনাবাহিনীর হামলা-হত্যা-ধর্ষণের মুখে ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
ভ্যাটিকান সিটি জানিয়েছে, গত ৬ নভেম্বর কফি আনান আরো তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে নিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কমিশনের ৬৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি পোপকে দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পরিহার করে শুধু ‘রাখাইন রাজ্যের মুসলিম’ ব্যবহার করা হয়েছে।
ভ্যাটিকান অবশ্য এ বৈঠকের বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি। তবে পরদিন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে নাশতার সময় কফি আনান জানান, যাঁরা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে চান, তিনি তাঁদের সঙ্গে একমত। তবে মিয়ামমারের শাসকদের ‘মনঃক্ষুণ্ণের’ কথা চিন্তা করেই এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া চ্যাপ্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রাবার্টসন মনে করেন, বছরের পর বছর ধরে দেশহীন, সেনাবাহিনীর নির্যাতনে কাবু এই ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীর আসলে কোথাও নেই। তিনি আশা করেন, পোপ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেই।
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সরকার প্রথম থেকেই ‘শরণার্থী’ না বলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাখাইন রাজ্য থেকে আসা জনগোষ্ঠীকে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়।
মিয়ানমার সরকারও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করে না। মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘ কার্যালয়ও তাদের বিভিন্ন সংবাদ বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির পরিবর্তে ‘রাখাইনের মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ