২০১৩ সালে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের তৃতীয় আসরে প্রথম অংশ নেয় বাংলাদেশ। মাত্র তিনটি ডিসিপ্লিনে সেবার খেলোয়াড় পাঠানো হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে আর্চারি ও তায়কোয়ানদোতে একটি করে রুপা ও ব্রোঞ্জ আসায় এ আসর নিয়ে আশা ও সম্ভাবনা বেড়ে যায় বাংলাদেশের। বাকুতে শুরু হওয়া এবারের চতুর্থ আসরে তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় শ্যুটিং ডিসিপ্লিনটি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরাবরই আশা-ভরসার প্রতীক শ্যুটাররা। বাকুতে সেই প্রত্যাশাও মিটিয়েছেন শ্যুটাররা গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশকে প্রথম সোনা এনে দিয়ে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের যে দুটি পদক এই আসরে সোনা ও রুপা—দুটিই শ্যুটিং থেকে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে শুধু শ্যুটিংয়েই ভর করা আর কত দিন? অন্য খেলাগুলোতে সম্ভাবনার জায়গা কতটা, সেগুলো কি সমানতালে এগোচ্ছে?
বাকুতে শ্যুটিংয়ের মতোই বড় দল গেছে সাঁতারে। গত এসএ গেমসে মাহফুজা আক্তারের দুটি সোনা জয়ে সাঁতারুদের ঘিরে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আট দেশের আসর থেকে ৫৪ দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে মাহফুজারা নিজেদের ছাপ রাখতে পেরেছেন সামান্যই। ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে মাহফুজা ফাইনালে খেললেও স্কোরে সেই উন্নতি নেই। গেমসে ৩৪.৮৮ সেকেন্ডে তিনি সোনা জিতে নিয়েছিলেন। বাকুতে করেছেন ৩৪.৮১, যেখানে ৩১.৮৯ করে এই ইভেন্টে সোনাজয়ী তুর্কি সাঁতারু। অর্থাৎ ব্যবধান এখনো বিস্তর। এসএ গেমসে ভারতীয় ভারোত্তোলকের রেকর্ড গড়ার চেষ্টা পণ্ড হওয়াতেই সোনা জিতে গিয়েছিলেন মাবিয়া আক্তার। সেই সুযোগ তিনি পাননি বাকুতে। মোট ১৭৮ কেজি তুলে এ আসরে ষষ্ঠ হয়েছেন তিনি। প্রথম হওয়া তুর্কি ভারোত্তোলক তুলেছেন ১৯৩ কেজি। আন্তর্জাতিক আসরগুলোতে সবচেয়ে করুণ চিত্র দেখা যায় অ্যাথলেটিকসে। বড় বড় আসরে মূলত দেশসেরা স্প্রিন্টারদেরই পাঠানো হয়। গেমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটারে অংশ নিয়ে সেই স্প্রিন্টারদের পারফরম্যান্স থাকে অনুল্লেখ্য। বাকুতে আব্দুর রউফ যেমন ৩১ জনের মধ্যে ২৮তম হয়েছেন ১১.২৮ সেকেন্ডে দৌড়ে। শ্যুটাররা সেই ব্যবধানই ঘুচিয়ে যেকোনো আসরে এখন পদকের স্বপ্ন দেখেন। এটা সম্ভব হয় কিভাবে? এর কারণ ব্যাখ্যায় সাবেক শ্যুটার সাইফুল আলম রিংকি বলছিলেন, ‘শ্যুটিংটা মূলত মানসিক খেলা। মনোযোগ ধরে রাখা, মানসিক দৃঢ়তার ব্যাপার এখানে। অন্য খেলাগুলোয় শারীরিক দক্ষতা অনেক বেশি প্রয়োজন হয়। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উন্নত অবকাঠামো লাগে। সেদিক থেকে হয়তো আমরা পিছিয়ে থাকি। কিন্তু শ্যুটিংয়ে এই ব্যবধানটা থাকে না। বড় বড় শ্যুটারেরও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার আমাদের কেউই দৃঢ়তা দেখিয়ে খুব ভালো করে ফেলতে পারে। ’
সাবেক অ্যাথলেট, বিকেএসপির অ্যাথলেটিকস কোচ আব্দুল্লাহেল কাফিও সাইফুল আলমের সঙ্গে একমত যে, শারীরিক যোগ্যতাই বড় পার্থক্য গড়ে দেয় অন্য খেলাগুলোতে, ‘শ্যুটিংয়ের পাশাপাশি এখন আর্চারিতেও আমাদের ভালো ফল হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ খেলাগুলোতে ফিজিক্যাল ফিটনেসের গুরুত্ব কম। কিন্তু অ্যাথলেটিকসে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে গেলেই শারীরিক দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে যাই অনেক খানি। ’ আবার শরীরের ওজনভিত্তিক ইভেন্টগুলোতেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে এ ব্যবধান অনেকটাই কমে যায়। ভারোত্তোলন, বক্সিংয়ের মতো খেলাগুলোতেও তাই বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখেন কাফি। আন্তর্জাতিক আসরের পারফরম্যান্সে সেই ইঙ্গিতও আছে, বক্সিংয়ে সেই আশির দশকেই এশিয়াড রুপা জিতেছেন মোশাররফ হোসেন। ভারোত্তোলন সেই সময়ে না হলেও কয়েক বছর ধরে গুরুত্ব পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আসরে অংশগ্রহণও বাড়ছে ভারোত্তোলকদের। মাবিয়া, সাবিরাদের ঘিরে এখন শুধু নতুন করে পরিকল্পনা সাজানোর অপেক্ষা।
‘শারীরিক দক্ষতার খুব প্রয়োজন নেই’—শুধু এ সুবিধা নিয়েই শ্যুটিং এগিয়ে যাচ্ছে এমনটা ভাবাও ভুল হবে। কারণ এ মুহূর্তে শ্যুটিং ফেডারেশনের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই আর কোনো ফেডারেশনের। শ্যুটিংয়ের মতো আর কোনো ফেডারেশনই গত রিও অলিম্পিক শেষ হতে না হতেই ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ভালো করার জন্য উঠেপড়ে লাগেনি। আর কোনো খেলার খেলোয়াড়রা শ্যুটারদের মতো নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন না আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতেও। আব্দুল্লাহেল বাকী, আতকিয়া হাসান ইসলামিক গেমস মিশন শেষ করে গতকাল দেশে ফিরেই যেমন আবার জার্মানির বিমানে চড়েছেন। সেখানে শ্যুটিং বিশ্বকাপে অংশ নেবেন। অলিম্পিক কোটার ভাবনা যে তাঁদের মাথায়। দুই বিদেশি কোচ বাকু থেকেই যাবেন জার্মানিতে। ক্রিকেটের পর এমন বিদেশি হাইপ্রোফাইল কোচও আছেন এখন একমাত্র শ্যুটিংয়েরই।