নিজস্ব প্রতিবেদক:
মোহাম্মদ আলী। বাসা পুরান ঢাকার আজিমপুরের। বয়স ৩৫। আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালালেও অবৈধ বলে তা নিয়ে গেছে পুলিশ। তাই মাসখানেক ধরে প্যাডেলচালিত রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন আলী।
সারাদিন রিকশা চালালেও দেশের সার্বিক খোঁজ খবর তার নখদর্পনে। যে কোনো বিষয় নাগরিক হিসেবে খোঁজ রাখা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। এই যেমন সবশেষ দেশজুড়ে আলোচিত বনানীর ‘রেইন্ট্রি হোটেলে’ দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনা। জড়িতদের গ্রেপ্তার, গ্রেপ্তারে ব্যবসায় ধস নামার আশঙ্কা, মূল অভিযুক্ত সাফাতের সাবেক স্ত্রী, তার মায়ের সম্পর্কে বিস্তারিত খবর, সাফাতের বাবা দিলদার হোসেনের কর্মকাণ্ড সব খবর রেখেছেন মোহাম্মাদ আলী।
তার আশঙ্কা, মালিকের ছেলের অপরাধের কারণে যেভাবে আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালানো হচ্ছে, দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাতে পথে বসতে হতে পারে মালিক দিলদার হোসেনকে।
ঘটনাস্থল মঙ্গলবার বেলা ১২টা। ঢাকা মেডিকেল মোড় থেকে শাহবাগের উদ্দেশে মোহাম্মদ আলীর রিকশায় ওঠা। সিগারেট খাওয়া অবস্থায় থাকলেও রিকশায় প্যাডল দিয়েই অর্থেক খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিলেন তিনি।
এরপর নিজেই শুরু করলেন বনানীর রেইন্ট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সাফাতের জীবনযাপন ব্যয়ের খবর দিয়ে।
বললেন, ‘মামা একদিনে দুই লাখ ট্যাকা? মাসে ৬০লাখ, তাইলে কত ট্যাকা কামাইছে।’
-কার কথা বলতেছেন?
-মামা, ক্যান জানেন না আপন জুয়েলারের মালিকের পোলা সাফাতের কতা।
-এই খবর আপনি জানেন?
-জানি মানি সব জানি। চিন্তা করেন, ৩০০ কেজি সোনা, কম নাকি? এক দোকানে এত সোনা। এমনি চললে তো মামা ওরা পঙ্গু হইয়া যাইবো। ওগো আয়ের যে রাস্তাডা ছিলো হেইডা তো বন্ধ হইয়া যাইবো।
‘মা-বাবার তো সন্তানদের ভালো পথে চলানো উচিত’-এমনটা বলতেই কথা টেনে রিকশাচালক বলেন,‘মামা ওর (সাফাত) মা কিন্তু বহুত ভালা মানুষ। ওর (সাফাত) বউটা ছিলো না যেইটা ডিভোর্স দিছে হে কিন্তু এইডা কইছে। কইছে সাফাতের বাবার জন্যই এই পথে গ্যাছে পোলাডা।’
কথার ফাঁকে টিএসসি পর্যন্ত চলে আসে আলীর রিকশা।
মোহাম্মদ আলী বললেন, ‘এতদিনের মান সম্মান, টাকা পয়সা সব শেষ হইয়া গেলো। আসলে মামা আপনি পাপ করলে একদিন না একদিন ওইডা বাইর হইবোই। একটা কামের লাইগা আইজ কি অবস্তা দেখেন!’
নির্যাতিত মেয়েদের একজনের সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে চিন্তিত এই রিকশাচালক। বলেন, ‘মেয়েরা যে স্টেসমেন্ট দিল, এই জায়গায় তো তাগো চেহারা ট্যাহারা সব দেখা গেছে। এডাও তো সমস্যা।’
টাকা পয়সা দিয়ে এই মামলা থামাচাপা পড়ে যেতে এমন চিন্তাও মাথায় ভর করেছে মোহাম্মদ আলীর। বললেন, ‘এমন ঘটনা কিন্তু অনেক ঘটতাছে, এটা আলোচিত। সাফাত একদিন কিন্তু বাইর অইয়া যাইব থামাচাপা দিয়া।’
বনানী ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় হলেও অন্য ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে দেশে আক্ষেপের শেষ নেই এই ‘সব জান্তা’র। বললেন, ‘মামা সাফাত গো এইডা নিয়ে কত কি হইতাছে। মাগার পাঁচ বছরের বয়সের একটা মেয়েরে বুইড়া ব্যাটা ধর্ষণ করল। ওই ব্যাটাও গ্রেপ্তারও হইছে। কিন্তু এইডা নিয়ে কিন্তু কোনো আলাপ আলোচনা নাই। ’
কথার ফাঁকে মোহাম্মদ আলীর নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, তার বাসা আজিমপুরে। তিনি ঢাকার ছেলে। চারভাই ও দুইবোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়।
জানান, মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। বাবার রেখে যাওয়া একটু টুকরো জমিতে দোতলা একটি বাড়ি আছে। ছয় কক্ষের ওই বাড়িতে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকেন।
বাসা ভাড়া না দেয়ার কারণ হিসেবে জানান, ‘বড় ভাই নামাজি মানুষ। ঝামেলা চায় না, তাই কোনো রুম ভাড়া না দিয়ে সবাই থাকি।’
বাসায় নিজের স্ত্রী ও এক সন্তান আছে জানিয়ে বলেন, ‘মামা ইচ্ছা আছে আর বাড়ির উপরের দিকে উঠানোর। দোয়া কইরেন। আগে নিজের ব্যাটারির রিকশা ছিলো, আয় ইনকামও বেশি ছিলো। কিন্তু পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর অহন ভাড়া রিকশা চালাই। ১৫০ ট্যাহা জমা দিতে হয়। তারপরও ৪০০ ট্যাহা, মাঝে মাঝে পাঁচশ থাহে। চলতাছে আল্লাহ ভালোই চালাইতাছে। বাসায় বইন একটা আছে ওর জামায় বিদেশ করে। সবাই ওর কাছে ট্যাহা দেই এমনি করেই চলতাছে।’
কথা বলতে বলতে সময় শেষ হয়ে যাত্রা পথ। পৌঁছে যাই শাহবাগ মোড়ে। মেনে ভাড়া সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন ‘সবজান্তা রিকশাচালক’ মোহাম্মদ আলী।
তবে এতসময় কথা বললেও সামনে থেকে তার ছবি তুলতে চাইলে কিছুটা বিব্রত হন মোহাম্মদ আলী। তাই সামনে থেকে ছবি তোলার আফসোসটা থেকেও গেলো!
দৈনিক দেশজনতা/এমএইচ