নিজস্ব প্রতিবেদক:
অসহনীয় কলড্রপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বেসরকারি মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা। তাদের অভিযোগ, গত মাস থেকে গ্রামীণফোনে কলড্রপের হার অবিশ্বাস্য রকম হারে বেড়ে গেছে। অতিষ্ঠ গ্রাহকেরা জানতে চান, কবে শেষ হবে কলড্রপের এই যন্ত্রণা! যদিও মোবাইল অপারেটরটির দাবি, তাদের যেটি হচ্ছে, সেটি আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের কলড্রপের নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক নিচে রয়েছে । গ্রামীণফোন বাজারে আসার পর থেকেই অপারেটরটির সিম ব্যবহার করছেন পুরান ঢাকার হাজি আলাউদ্দিন খন্দকার। তার কাছেও ইদানিং গ্রামীণফোনের সার্ভিস ভিন্ন রকম লাগছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘কলড্রপ ছিল না তা বলা যাবে না। কিন্তু, ইদানিং গ্রামীণফোনের কলড্রপটা একটু বেশিই হচ্ছে। ব্যবসার কাজে, আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাইন কেটে যাচ্ছে। বেশ বিব্রত হতে হচ্ছে।’
হাজির ভাষ্যে, ‘এই অপারেটরের নেটওয়ার্ক সবচেয়ে ভাল, প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে পুরনো এবং দেশের সেরা দাবি করে। তারপরও তারা যদি এমন বিড়ম্বনা দেয়, তাহলে গ্রাহকেরা যাবেন কোথায়?’
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা রনি বলেন, ‘জরুরি একটা কল আসছে, মিনিট দশেকের মধ্যে কখনও পাঁচ থেকে ছয়বার কলড্রপ হচ্ছে। তখন নিজেকে বেশ অপমাণিত বোধ করি। ইদানিং কথাও পরিষ্কার শোনা যায় না। গ্রামীণফোনের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমন বাজে সার্ভিস প্রত্যাশিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোন একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান, যার গ্রাহকসংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং গ্রাহকদের ভোগান্তির বিষয়টা তাদের নজরে রাখা উচিত।’
সোমা নামে গ্রামীণফোনের আরেক গ্রাহক জানান, গত মাস থেকে কলড্রপের মাত্রা ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, তার ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে। পরে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তারাও এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে প্রায়ই পড়ছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘অনেক সময় কল রিসিভ করার পরপরই কেটে যাচ্ছে। এমনও হয়েছে যে, তিন মিনিট কথা বলতে চারবার কল কেটে গেছে। তারা গ্রাহকদের ভালো নেটওয়ার্কের আশ্বাস দিয়ে ভোগান্তিতে ফেলছে, এটা এক কথায় প্রতারণা।’
হামিদুল নামে আরেক গ্রাহক বলেন, ‘শুধুমাত্র ভাল নেটওয়ার্কের কারণে দীর্ঘদিন গ্রামীণফোন ব্যবহার করে যাচ্ছি। দেশে এত মোবাইল ফোন অপারেটর এল কিন্তু, অন্য কোনোটাই বেছে নেইনি। অথচ গ্রামীণের কলরেট সবচেয়ে বেশি। কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, তার ওপর কয়েক দিন ধরে কলড্রপের সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাদের সেবার মান আগের মতো নেই, অনেক নেমে গেছে।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য মতে, বর্তমানে মোবাইল কোম্পানিগুলোর দিনে মোট কলের সংখ্যা প্রায় ১৮০ কোটি মিনিট। এর মধ্যে গড় কলড্রপের হার ১ শতাংশ। সে হিসেবে প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লাখ মিনিট কলড্রপ হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো দিনে কলড্রপ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে গ্রাহক প্রতি কলড্রপের হার ০.১১ শতাংশ।
বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া উইং) মো. জাকির হোসেন খাঁন বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোতে কলড্রপ হচ্ছে, জনগণ ভুগছে। আমাদের কাছে যে কলড্রপের তালিকা আসছে না তাও কিন্তু নয়। তালিকা আসছে, আমরা কোয়ালিটি অব সার্ভিসগুলো দেখছি। কলড্রপ কমিয়ে উন্নত গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করার জন্য বিটিআরসির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটারনাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামালবলেন, ‘রেডিও প্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল সেবায় কলড্রপ একটি স্বাভাবিক উপসর্গ। তবে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে কলড্রপের পরিমাণ সব সময়ই বিটিআরসি নির্ধারিত মানদণ্ডের অনেক নিচে রয়েছে। এছাড়া আমরা গ্রাহকদের কলড্রপের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকি।’
গ্রামীণফোনের উপ-ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. হাসান বলেন, ‘আমাদের নেটওয়ার্কে কত পার্সেন্ট কলড্রপ হয়, তার একটি তালিকা আমরা প্রতিমাসে বিটিআরসিতে জমা দেই। ইন্টারন্যাশনাল বেজমেন্ট অনুযায়ী ৩ শতাংশের বেশি কলড্রপ হলে বুঝে নিতে হবে অপারেটরের নেটওয়ার্ক খারাপ। সেক্ষেত্রে গ্রামীণফোন এখনও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে।’
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, ‘শুধু গ্রামীণফোন নয়, সব অপারেটরেই কলড্রপের সমস্যা হবে। কোয়ালিটি অব সার্ভিসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে টেকনিক্যালি বুঝতে হবে। আমাদের দেশের মতো বাইরের দেশগুলাতেও কিন্তু কলড্রপ হচ্ছে। আমাদের দেশে কোয়ালিটি অব সার্ভিস ইমপ্রুভ করার জন্যই তো সরকার টেকনোলজি নির্ধারিত দিচ্ছে, এতে করে ইউজার বেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে পরিমিত স্পেক্টামের অভাব আছে। সেটা করলে কোয়ালিটি অব সার্ভিসটা বাড়বে।’
তিনিও বলেন, ‘যে পরিমাণ কলড্রপ হচ্ছে, সেটা এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অতিক্রম করেনি। রেডিও কমিউনিকেশনের সব জায়গায় সব ধরনের ফ্রিকুয়েন্সি থাকে না। তাই কখনও কখনও ড্রপ করে। সেকেন্ডলি শুধুমাত্র মোবাইল অপারেটরের সিগন্যালের উপরেই কিন্তু কলড্রপ হয় না। আরও কোনো না কোনো কারণ থাকতে পারে। এন্টিটিওর অপারেটররা ফাইবারের মাধ্যমে কানেক্টিভিটিটা দেয়, সেখানেও যদি কোনো সমস্যা হয়, সেটাও আল্টিমেট কানেক্টিভিটিকে হ্যাম্পার করতে পারে।’
নুরুল কবীর আরও বলেন, ‘আসলে সত্যি বলতে কি অপারেটরগুলোর হা-পা বাধা। তাদের অনেক কিছুর ওপর নির্ভর হয়ে কাজ করতে হয়। আর এই নির্ভরতাগুলোই তাদেরকে চেপে ধরে রেখেছে। অন্যদিকে আমরা এটাও মনে করি, গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবাটা দেওয়া জরুরি, আর এটা দেওয়ার জন্য তারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমি অস্বীকার করছি না কলের সার্ভিসে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে এ সমস্যাগুলোর জন্য শুধু মোবাইল অপারেটররা দায়ী না।’
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ