২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৫২

রাতের আঁধারে ‘সিস্টেম’ চলছে অবৈধ কাপড়ের

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাত সাড়ে ১১টা। পুরান ঢাকার ইসলামপুরের সামনের রাস্তায় দিনের মতো যানজট নেই। দুই ধারে কাপড়ের আড়তগুলোতেও নেই তেমন ভিড়। রাস্তায় ঢুকছে দু-একটি ট্রাক। সেগুলো থেকে কাপড় নামিয়ে গুদামে নিচ্ছে শ্রমিকরা। তবে ৭৬ নম্বর এলান মার্কেটের সামনের পরিবেশটি একটু ভিন্ন রকমের। ট্রাক থেকে নয়, সেখানে আরেকটি মার্কেট থেকে কাপড়ের রোল নিয়ে বড় বান্ডেল তৈরি করছে শ্রমিকরা। এক শ্রমিক বলে, ‘সেগুলো পায়জামা, প্যান্ট, শার্টের টিসি। গার্মেন্ট আইটেম, বিদেশি কাপড়। বিক্রি হয়েছে। এখন নতুন করে বান্ডেল করতে হবে। ’ জানতে চাইলে আরেক শ্রমিক বলে, ‘বিদেশি বন্ডের কাপুড়। ঝামেলা আছে। তাই একটু সিস্টেম কইরা নিতে হয়। ’

গত রবি ও সোমবার রাতে সরেজমিনে ইসলামপুর মার্কেটে গিয়ে কয়েকটি স্থানে এমনই ‘কাপড়ের সিস্টেম’ দেখা গেল। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ইসলামপুরে দেদার বিক্রি হচ্ছে বন্ড বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানিমুখী কারখানার জন্য আমদানি করা কাপড়। এ কাপড় রাতের আঁধারে ট্রাক থেকে নামিয়ে গুদামে ঢোকানো হয়। রাতেই বান্ডেল বদলে স্থানান্তর করা হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা নজরদারি এড়াতে ইসলামপুর থেকে দূরের এলাকায় ট্রাক থেকে কাপড় নামিয়ে সেখানে আনে। শুল্কমুক্ত সুবিধার এসব বিদেশি কাপড় বিক্রির কারণে দেশি কাপড়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। চীন, তাইওয়ান ও ভারতের কাপড়ই বেশি। ঈদের বাজারকে সামনে রেখে গুলশান আরা সিটি ও বিক্রমপুর গার্ডেনসহ কয়েকটি মার্কেটে মজুদ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি কাপড়। বিক্রিও ভালো। দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কারবার চললেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নির্বিকার। দায় এড়িয়ে চলছেন সেখানকার ব্যবসায়ী নেতারাও।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মইনুল খান বলেন, ‘বন্ড সুবিধার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির ব্যাপারে আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই। এর মাধ্যমে অনেক মালপত্র জব্দ করা হয়েছে। পুরান ঢাকায় যদি বন্ডের পণ্য বিক্রি হয় সে ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

ইসলামপুর ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে কিছু অসাধু ব্যক্তি অবৈধ কাপড় বিক্রি করে। এতে দেশি কাপড়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে আমাদের কাছে তেমনভাবে অভিযোগ নেই। আমরা নতুন কমিটি। কিছুদিন পরে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে কাস্টমস, বন্ডসহ প্রশাসনের অনেকে কাজ করেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি। ’

সংগঠনটির সদ্য সাবেক হওয়া সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম সরদার বলেন, ‘অতীতের চেয়ে এখন ইসলামপুর ও এর আশপাশের কাপড়ের মার্কেটে বেশি অবৈধ কাপড় বিক্রি হচ্ছে। এখানে বিদেশি কাপড় যা পাবেন তার ৮০ ভাগই বন্ডের, অবৈধ। ঈদকে সামনে রেখে গত ৫ তারিখ পর্যন্ত ট্রাক ভরে কাপড় এসেছে। এসব মাল এখন বিক্রি হচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এবং কিছু মুনাফালোভী কারবারির কারণে পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ’

জানা গেছে, ইসলামপুর ও এর আশপাশে প্রায় ছয় হাজার কাপড়ের দোকান আছে। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সেখানে শাড়ি, প্যান্ট-শার্টের কাটা কাপড়, এক রঙের ও প্রিন্টের কাপড় বেশি বিক্রি হয়। বিদেশি কাপড়ের চাহিদাই বেশি।

এলান মার্কেটের সামনে বিদেশি কাপড় নতুন করে বান্ডেল করা শ্রমিক ইব্রাহিম বলেন, ‘এগুলো গুলশান আরা মার্কেট  থেকে আসছে। বাগদাদ ট্রেডিংয়ের কাপড়। এগুলো কোথায় যাবে আমরা জানি না। আমরা শুধু বান্ধি (বেঁধে দেওয়া)। ’ শ্রমিকরা বলেন, ২০টা রোল দিয়ে একটি বেলি তৈরি করা হয়। এর ওপর পলিথিন মোড়ানো হয়।

এতে আর কাপড়ের সিল দেখা যায় না।

সোমবার রাত ১১টার দিকে ইসলামপুর রোডের ১৮ নম্বর ভবনের সামনে একটি ঠেলাগাড়ি থেকে একই রকম কাপড়ের রোল নামাতে দেখা যায়। শ্রমিকরা সেগুলো ভেতরের গুদামে নিয়ে রাখছিলেন। প্রতিটি বান্ডেলে ‘মেইড ইন চায়না’ লেখা রয়েছে। সেখানে মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া গেল না। শ্রমিকরা দাবি করেন, কাপড়গুলো হাজি বাদশা মিয়া মার্কেটের চীনা কাপড়।

জানতে চাইলে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, ঈদের বাজার সামনে রেখে এপ্রিল মাসজুড়ে ট্রাকে করে কাপড় এসেছে। এখন সেগুলো বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মজুদ করা হয়েছে গুলশান আরা মার্কেট ও বিক্রমপুর সিটি মার্কেটে। অবৈধ কাপড়গুলো দিনে বিক্রি হলেও রাতে বান্ডেল বদলে ক্রেতার কাছে পাঠানো হয়।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, মার্কেটে আসা অন্তত ৩০ শতাংশ কাপড়ই চোরাই পথের। সীমান্তে চোরাচালান এবং কর ফাঁকি দিয়ে আসা বিদেশি কাপড় স্থানীয় কাপড়ের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি হয়। ফলে অবৈধ কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না দেশি কাপড়।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, কয়েক দিন আগেও গভীর রাত পর্যন্ত ইসলামপুরে অবৈধ কাপড়ভর্তি ট্রাক ঢুকেছে। এখন ঈদ বাজারের চাহিদা শেষ হওয়ায় ট্রাকের সংখ্যা অনেক কম। দূরে থামা ট্রাক থেকে বা ভিন্ন গুদাম থেকে ঠেলাগাড়িতে অল্প করে কাপড় সরানো হচ্ছে।

দৈনিক দেশজনতা/এমএইচ

 

প্রকাশ :মে ১৭, ২০১৭ ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ