২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:৪২

মানুষ মানুষের জন্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একদিকে অত্যাচার, নিপীড়ন অন্যদিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকা জনগণ। সীমান্তের একদিকে নিজ দেশের মানুষকে গুলি করে হত্যা করা আর সীমান্তের অন্যদিকে সেই পরিবারের বেঁচে যাওয়া শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মানুষের প্রাণপণ চেষ্টা। নাফ নদীর পানিতে একদিকে যেমন বইছে মিয়ানমারের গণহত্যার রক্তের স্রোত আর অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণে বইছে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য ভালোবাসার ফল্গুধারা।
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু মানুষের জীবনে খানিকটা স্বস্তি এনে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা বাংলাদেশের মানুষের। দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ সবাই এসে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের পাশে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দান করছেন একদিনের বেতন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন চাঁদা তুলে পাঠাচ্ছেন রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমার সরকারের গত আগস্ট থেকে শুরু করা ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ এর নির্মমতা গোটা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নির্বিচারে গুলি, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, সীমান্তে মাইন বিছিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে। চলমান বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড় বইছে বিশ্বজুড়ে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে মিয়ানমার সরকারকে, কিন্তু এতেও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষের ঢল এখনও থামেনি। রোহিঙ্গা নিধন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কী তাদের এ অভিযান কেউ থামাতে পারবে না?
মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও তাদের দোসর সশস্ত্র রাখাইন যুবকদের নির্মম নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি অংশ স্বামীহারা, গর্ভবতী, প্রসূতি মহিলা ও মা-বাবা হারা এতিম শিশু। এসব শিশুকে সুন্দর পরিবেশে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইউনিসেফসহ বিভিন্ন এনজিও। ইউনিসেফ বলছে, এসব শিশুকে বার্মিজ ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে ঝুপড়িতে ২২৮টি পাঠদান কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তাদের বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষিত রোহিঙ্গা যুবকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইওএম-এর তথ্য মতে ক্যাম্পে বর্তমান ৯ হাজার গর্ভবতী মহিলা রয়েছেন। যাদের মধ্যে ৬৩৫ জন গর্ভবতী ইতোমধ্যে সন্তান প্রসব করেছেন। এমএসএফসহ বিভিন্ন এনজিও এসব গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলার চিকিত্সা সেবা প্রদান করলেও তারা স্বজনহারা বেদনায় শোকাহত।
সেনাবাহিনী কাজে যোগ দেওয়ার পর শৃঙ্খলা
 গত ৮ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী ক্যাম্পে কাজ শুরু করে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে ফিরে আসে শৃঙ্খলা। সেনা সদস্যরা প্রথমে রাস্তার দুপাশ থেকে রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি উচ্ছেদ করে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেনাবাহিনী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করলে ২/১ দিনে ফাঁকা হয়ে যায় উখিয়া থেকে পালংখালী পর্যন্ত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সড়ক পথ। পরবর্তী সময়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা নিবন্ধনের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি ক্যাম্পের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে আসার কারণে ক্যাম্পের পরিবেশ উন্নত হয়ে উঠে। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করে।
স্থানীয়দের উদ্যোগ
 মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য, কাপড়, বাঁশ, গাছ, পলিথিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় গ্রামবাসী। উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধূরীর নেতৃত্বে খোলা হয়েছে লঙ্গর খানা। ওই লঙ্গর খানা থেকে সকাল-সন্ধ্যা ৫ হাজার রোহিঙ্গার মাঝে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। উখিয়ার কেন্দ্রীয় ফোমাস সংসদের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করেছে স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গাদের তাত্ক্ষণিকভাবে আশ্রয় নেওয়ার জন্য জায়গা দিয়েছে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়নের সদস্যরা। এ ছাড়া স্থানীয় মহিলারা তাদের খাবার পানি সরবরাহ করে আতিথেয়তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রাণ সামগ্রী আসতে শুরু করে। এ সময় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যে যার ইচ্ছা মতো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছিল। এসব ত্রাণ সামগ্রী হুড়োহুড়ি করে নিতে গিয়ে শত শত রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। ক্যাম্পে একটি অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গারা যে যার ইচ্ছা মতো ঝুপড়ি নির্মাণ করায় কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
শিশুদের পাঠদান কেন্দ্র
 বালুখালী, কুতুপালং, লম্বাশিয়া, এলাকায় অস্থায়ীভাবে গড়ে উঠা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, ইউনিসেফ পরিচালিত শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি (আমরা করব জয়) পরিবেশন করা হচ্ছে। পাহাড় ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি ঝুঁপড়িতে চলছে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় শিক্ষাদান। ইউনিসেফের প্রোগ্রাম অফিসার হুমায়ুন কবির জানান, এসব শিশুর ছোটকাল থেকে গড়ে তোলা না হলে দীর্ঘ মেয়াদি বসবাসের সুযোগে এসব শিশু বিভিন্ন অপরাধসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি জানান, তাদের স্কুলগুলোতে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন করে শিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ কার্যক্রমে শিশুর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে শিফট করা হয়েছে। প্রতি শিফটে ৩৫ জন শিশু নিয়ে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সীদের একটি করে দল করা হয়েছে। ১৪ বছর বয়সীদের তিন শিফটে ১০৫ জন করে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হচ্ছে। ইউনিসেফ কর্মকর্তা ফারিয়া সেলিম জানান, বিশাল শরণার্থীর কঠিন মুহূর্তে পাঠদান কেন্দ্রগুলো হচ্ছে শিশুদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান।
২২৮ কেন্দ্রে ১৯ হাজার শিশু শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ক্যাম্পে গিজগিজ করা এসব শিশু একটি আপাত সুন্দর পরিবেশে সময় কাটাতে পারছে। ইউনিসেফ বলছে, আগামী ৬ মাসে কেন্দ্রের সংখ্যা হাজারে উন্নীত করা হবে। সেখানে প্রায় ২ লাখ শিশু অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে।
অনাগত শিশু ও মায়ের যত্ন
 মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার গর্ভবতী মহিলা রয়েছেন। তাদের এখানে পালিয়ে আসার পথে বনজঙ্গলে সন্তান প্রসব করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন জানান, উখিয়ার ৬টি ক্যাম্পে ২০টি মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে। সেখানে গর্ভবতী মহিলাদের আলাদাভাবে পরিচর্যা, চিকিত্সা সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মহিলাদের সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অথবা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার এমএসএফ হল্যান্ড, ল্যাব এইড, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ন্যাশনাল হসপিটালে গিয়ে দেখা যায়, গর্ভবতী মহিলা, প্রসূতি ও অসুস্থ শিশু রোগীর ভিড়।
কুতুপালং কমিউনিটি সেন্টারে নিয়োজিত চিকিত্সক অজিত কুমার বড়ুয়া জানান, ঠাণ্ডাজনিত কারণে শিশুরা নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়া প্রসূতিদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। ল্যাব এইডের চিকিত্সা কেন্দ্রের ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন আজাদ জানান, তারা মূলত শিশুদের সুরক্ষা ও গর্ভবতী মহিলাদের নিয়ে কাজ করছেন। তাদের জন্য আলাদাভাবে চিকিত্সা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তিনি জানান, আগামী একমাস এ কার্যক্রম চালু থাকবে। সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে চিকিত্সা সেবা আরো সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এতিম শিশুদের জন্য উদ্যোগ
 মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৬০ ভাগ শিশু। এদের মধ্যে এতিম শিশু রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার। এসব শিশুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রশাসন এসব শিশুর আলাদাভাবে সুরক্ষার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে ২শ’ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, এসব এতিম শিশুকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলাদা সেবা কেন্দ্র থাকবে। যেখানে এতিম শিশুরা চাহিদা মতো পোশাক, খাদ্য, স্বাস্থ্য সেবা ও খেলাধুলার সুযোগ থাকবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৭৯ হাজার রোহিঙ্গাকে কলেরা ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্মকর্তা মোঃ ইকবাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ হাজার একশ’ ৩১টি টয়লেট, ২ হাজার ১শ’ ৬৪টি নলকূপ, মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ৭টি ও ১শ’ ২৮টি গোসলখানা নির্মাণ করা হয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ
প্রকাশ :অক্টোবর ২১, ২০১৭ ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ