দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:
মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চিকেই সব কিছুর জন্য দায়ী করেছেন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী। এক খোলা চিঠিতে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রো মাইয়ু আলী সু চিকে দায়ী করেছেন।
২৬ বছর বয়সী এই যুবক লেখক হতে চান। নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন প্রিয় পাঠাগার। কিন্তু সেনাদের দেয়া আগুনে সব হারিয়েছেন। এখন ঠাঁই পেয়েছেন কুতুপালংয়ের এক আশ্রয় ক্যাম্পে।
আলজাজিরার মাধ্যমে তার এক সময়ের প্রিয় নেত্রী অং সান সু চিকে এক খোলা চিঠি দেন।
চিঠির শুরুতে অং সান সু চিকে ওই রোহিঙ্গা বলেন, আপনি যে বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সে বছরেই আমার জন্ম। আপনার নোবেল প্রাপ্তি মিয়ানমারের মানুষের জন্য ছিল এক বিশাল গর্ব এবং সম্মানের ব্যাপার। রাখাইনের মংডু আমার এলাকা। ওই এলাকার প্রতিটি মানুষ আপনার নোবেল প্রাপ্তির আনন্দে ভেসে যায়। যেন এই আনন্দ শুধু আপনার একার নয়, এ বিজয় সমগ্র মিয়ানমারের। এ আনন্দের ঢেউ খেলে যায় আমাদের মাঝেও।
সূচির উদ্দেশে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, আপনার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পরে আমরা রোহিঙ্গারা প্রথমবারের মতো গর্বের সঙ্গে অনুভব করি যে, আমরাও এ দেশের অংশ। কয়েক দশক ধরে সামরিক জান্তার হাতে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য আপনার নোবেল প্রাপ্তি বয়ে এনেছিল আশার আলোকবর্তিকা। আমি ছোটবেলা থেকেই দাদার মুখে আপনার প্রশংসা ও গুণগান শুনেছি। আপনার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রতি আমার দাদু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এ জন্য তিনি আপনার দলের নেতারা কখনো আমাদের এলাকায় কাজে এলে তাদের আপ্যায়নে নিজের গোয়ালের সবচেয়ে বড় ছাগল এবং গরু জবাই করতেন। তিনি তাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতেন। আমার বাবা এবং দাদা আপনার প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, তারা চাইতেন আমি আপনার পথ অনুসরণ করি। আমার মাও আপনার বক্তব্য এবং জীবনবোধের অনুসারী।
চিঠিতে একপর্যায়ে বলা হয়, ২০১০ সাল আপনি যখন গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেলেন, সেদিন ছিল আমাদের এক আনন্দঘন দিন। কিন্তু এর সাত বছর পর, এখন আমরা রোহিঙ্গারা নৃশংসতার শিকার। আমরা জাতিগত নিধনের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এবং এবার স্বয়ং আপনার ইন্ধনেই তা ঘটছে। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর আপনি এনএলডি দল থেকে মুসলমান প্রতিনিধিদের সরিয়ে দিলেন। এটা ছিল আপনার রাজনৈতিক ভীরুতার প্রথম পদক্ষেপ। এর কয়েক মাস পরেই আপনার প্রশাসন উত্তর রাখাইনে ‘নিধন অভিযান’ শুরু করল। এ সময়ে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হলো। হাজারো নারী গণধর্ষণের শিকার হলেন। আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার মুখে দাঁড়িয়ে আপনি সহিংসতার কথা অস্বীকার করলেন। আপনি আমাদের ঐতিহ্যবাহী রোহিঙ্গা পরিচয়কে অস্বীকার করলেন। শতকজুড়ে রাখাইনের থাকা রোহিঙ্গাদের আপনি বহিরাগত বললেন। গত ২৫ আগস্ট থেকে হত্যা, নির্যাতন, সহিংসতার শিকার হয়ে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে চলে গেছে। যারা এখনো মিয়ানমারে আটকে আছে, তারা মৃত্যুভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ১ সেপ্টেম্বর আমি ও আমার পরিবার বাধ্য হই দেশত্যাগ করি। তিন দিন-দুই রাতের দীর্ঘ যাত্রায় আমরা ছোট্ট একটি নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করি। পরবর্তীতে আমাদের ঠাঁই হয় কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে। এখানে আসা মাত্রই জানলাম যে রাখাইনে আমাদের আবাসস্থল আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রোহিঙ্গা চিঠিতে আরও বলেন, লোকে হয়তো বলবে, এ ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী সামরিক জান্তা কিংবা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। আমি বলব, এ দায় কেবল আপনার। আপনি শুধু আমার ঘরই জ্বালিয়ে দেননি, জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমার বই। আপনি জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমার স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ। আমার স্বপ্ন ছিল সিতউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ে একজন লেখক হওয়ার। কিন্তু সু চি, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গাদের পড়াশোনা করা নিষিদ্ধ। তাই আমি বাধ্য হয়ে বইপত্র এবং প্রবন্ধ পড়ে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। আপনি শুধু রোহিঙ্গাদের হত্যা করেননি, আপনি হত্যা করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শকে। আপনি হত্যা করেছেন মহাত্মা গান্ধীর দীক্ষাকে। আপনি হত্যা করেছেন মানবজাতির মূল অহংকার-মানবতাকে।
সু চি একটি প্রশ্ন রেখে আপনার প্রতি আমার বাবার একটি প্রশ্ন আছে। সে প্রশ্নটি হলো, শান্তির নোবেল জয়ী, এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও একটি বারের জন্য আপনি আমাদের নিপীড়িত রাখাইনদের দেখতে রাখাইন রাজ্যে অথবা বাংলাদেশে এলেন না কেন? আপনার আদৌ এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা আছে? আপনি আপনার পথ বেছে নিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার রক্তের জন্য আপনার নাম পৃথিবীতে অবশ্যই অমর হয়ে থাকবে। তবে তা কি শান্তিতে নোবেলের জন্য, না কি আপনার নারকীয় নৃশংসতার জন্য এর ভবিষ্যতের কোনো এক সময় পাওয়া যাবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি