নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে লাভের মুখ দেখছে না। মাসের পর মাস ব্যয়ের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। গাড়ি চলছে, কিন্তু রাজস্ব জমা হচ্ছে না। এ নিয়ে খোদ বিআরটিসিতেই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তদন্তে প্রমাণও মিলেছে। কিন্তু অভিযুক্তরা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। বিআরটিসির ২১টি ডিপোর মধ্যে ১৮টি বাস ডিপোতেই রয়েছে অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা। ঠিকাদার, চালক ও ডিপো ম্যানেজাররা মিলে চক্র গড়ে উঠেছে। বিআরটিসির প্রধান অফিসের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত এ চক্রের সাথে। তাদের কারণে ডিপোগুলোয় ১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। টাকা আদায়ের জন্য বারবার নোটিশ দিলেও সাড়া দিচ্ছে না জড়িতরা। ইজারা পদ্ধতিতে চলছে ১১৫টি বাস। বাসগুলোর ইজারাদারদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে বিআরটিসির পাওনা রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘদিন থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে ভিত্তি গড়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। দিনের পর দিন গাড়ি চলছে না। কিন্তু বিল ঠিকই হচ্ছে। টায়ার, মবিল পরিবর্তনের ভুয়া বিল। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি এরকম একটি অভিযোগের তদন্তে সত্যতা পেয়েছেন বিআরটিসির তদন্তকারী সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল বাস ডিপো থেকে ঢাকা-টুঙ্গিপাড়া রুটে চলাচল করে ১১টি অশোক লিল্যান্ড এসি বাস। মতিঝিল বাস ডিপোর চালক রাজু আহম্মেদ নিজ দায়িত্বে তা পরিচালনা করেন। ফেরি পারাপারে লঞ্চে ভাড়া কম হওয়ায় বাসের যাত্রীদের লঞ্চে পারাপার করা হয়। কিন্তু ডিপোতে জমা দেয়া হতো ফেরির রসিদ। এতে ট্রিপপ্রতি ৮২০ টাকা করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এভাবে ২০১৪ সাল থেকে ওই ব্যক্তি আত্মসাৎ করেছেন ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৯০ টাকা। বিআইডব্লিউটিসি’র রিপোর্ট অনুসারে ডিপোতে জমা দেয়া ভাউচারগুলো অবৈধভাবে ছাপানো।
দেশে ২১টি ডিপো রয়েছে বিআরটিসি’র। এরমধ্যে ট্রাকের দুটি, বাসের ১৯টি। এসব ডিপোতে পড়ে আছে সারি সারি বাস। মিরপুর, কমলাপুর. মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর ও গাবতলী ডিপো ঘুরে দেখা গেছে সেখানে রাখা হয়েছে জরাজীর্ণ বাসগুলো। ডিপোতে পড়ে থাকা বাস দেখিয়ে যেমন বিল করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি চলাচলরত বাসের টাকা পুরোটা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি পুরনো মবিল দেখিয়ে নতুন মবিলের বিল, নিম্নমানের টায়ার, যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে অতিরিক্ত বিল আদায় করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্র।
সিলেটের আলমপুর বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে বাস রিজার্ভ দেয়া হয়। কিন্তু রিজার্ভের অনুকূলে কোনো রাজস্ব জমা হয়নি। চালকরা জানান, অফিস থেকে রিজার্ভ দেয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি তারা জানেন না। শেষ পর্যন্ত এরকম একটি অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।
বিআরটিসি নিজেরা পরিচালনা করছে ৮৫১টি বাস। ইজারা পদ্ধতিতে চলছে ১১৫টি বাস। বাস ইজারা নেয়া ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় অংকের টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। প্রায় প্রতি ডিপো ম্যানেজারের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। প্রতিটি ট্রিপে এক থেকে দুই হাজার টাকা ডিপো ম্যানেজারকে দিলে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া যায় সহজেই। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিল থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ৭৫ আসনের দু’তলা বাসের ঠিকাদারদের নির্ধারিত রাজস্ব জমা দেয়ার কথা ৬ হাজার ৩শ’ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চালক জানান, ৮৮ কিলোমিটারের এই ট্রিপে প্রায় ৯ হাজার টাকা পান ঠিকাদার। তার পরও রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। সূত্রমতে, বিআরটিসি’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের সমন্বয়ে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই বছরের পর বছর দুর্নীতির মহোৎসব চালাচ্ছে। তাদের কারণেই রাজস্ব হারাচ্ছে বিআরটিসি। এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে দীর্ঘদিন রাজস্ব জমা হয়নি। এই রাজস্ব আদায় করার জন্য জড়িতদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। তার পরও রাজস্ব জমা না হলে মামলা করা হবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি