নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ২৮ কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু উৎসে কর আদায় হয়েছে ৩৩ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা মোট করের ৫৩ শতাংশ। কয়েক বছরের গড় আদায় হিসাব করলে উৎসে করের অংশ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ শতাংশ। অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এ বিপুল অংকের কর আদায়ের সঙ্গে কর কর্মকর্তাদের তেমন কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে। এ ছাড়া কর্পোরেট কর আদায়েও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা কম।
অপরদিকে গত অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা আদায় হয়, যা মোট আয়করের ৫ শতাংশ। এ কর আদায় করতেই ৩৫টি কর অঞ্চলের ৬৫০ কর সার্কেলের অধীনে কর্মরত ১৫শ’ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাকে ঘাম ঝরাতে হয়। এরপরও অর্থনীতির সম্ভাবনা অনুযায়ী ব্যক্তি-শ্রেণীর করদাতাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কর আদায় করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র স্বীকার করেছে, দেশের সিংহভাগ আয়কর আদায়ে কর্মকর্তাদের অবদান খুবই সামান্য। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিল, ফি পরিশোধসহ ৫৬টি খাতের বিপরীতে উৎসে কর আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। কর্পোরেট করের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই নিজেদের কর হিসাব করে অগ্রিম কর আকারে এবং রিটার্ন জমার সময় বাকিটা পরিশোধ করছেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রতি অর্থবছরেই মোট আয়করের ৫৫-৬০ শতাংশ অর্থ উৎসে কর হিসেবে আদায় করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৩ হাজার ২০৭ কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়। এর মধ্যে শুধু উৎসে কর হিসেবে আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, যা মোট আয়করের প্রায় ৫৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। উৎসে কর আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা, যা মোট আয়করের ৫৯ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৩ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়েছে। এর মধ্যে উৎসে কর বাবদ ৩১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা মোট করের ৬০ শতাংশ। বর্তমানে ৫৬টি খাত থেকে উৎসে কর আদায় করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি বেতন, ঠিকাদারের বিল, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানতের সুদ আয়, জমি কেনাবেচা, সংবাদপত্র, রেডিও-টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন, পেশাগত কারিগরি সেবাদানকারী অথবা কারিগরি সহায়তা ফি, ক্যাটারিং সার্ভিস, ক্লিনিং সার্ভিস, কালেকশন অ্যান্ড রিকভারি সার্ভিস, প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস, ম্যানপাওয়ার সাপ্লাই সার্ভিস, ক্রিয়েটিভ মিডিয়া সার্ভিস, পাবলিক রিলেশন সার্ভিস, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস, ট্রেনিং-ওয়ার্কশপ ফি, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কারিগরি সেবা প্রদানকারী বা সেবা সরবরাহকারী এজেন্টের ফি, ক্রেডিট রেটিং সেবা ফি, মোটর গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপের ফি, বেসরকারি কনটেইনার পোর্ট বা ডকইয়ার্ড সেবার ফি, শিপিং এজেন্সি কমিশনের বিপরীতে নির্ধারিত হারে উৎসে কর আদায় করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উৎসে কর ও কর্পোরেট কর থেকে আয়করের প্রায় ৭০ শতাংশ আদায় হয়। এরপরের অবস্থানে অগ্রিম আয়কর। এ অগ্রিম কর ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতারা দিয়ে থাকে। কোম্পানিগুলো নিজেরাই নিজেদের ট্যাক্স হিসাব করে কর্পোরেট ও অগ্রিম আয়কর রিটার্নের সঙ্গে পরিশোধ করে। এতে কর কর্মকর্তাদের অবদান সামান্য। শুধু ব্যক্তি-শ্রেণীর করদাতাদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য দেশে ৩৫টি কর অঞ্চল আছে। এতে প্রায় ১৫শ’ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োজিত আছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নির্ধারিত সময়ে ১২ লাখ ৯৬ হাজার ব্যক্তি-শ্রেণীর করদাতা কর দিয়েছে। এ থেকে আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা ওই বছরের আয়কর আদায়ের ৫ শতাংশের মতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কর উৎস থেকে আদায় করা হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি কম। বর্তমান কর ব্যবস্থায় একজন কর্মকর্তাকে উৎসে কর আদায় মনিটরিংসহ ব্যক্তি-শ্রেণীর করদাতা, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আহরণের কাজ করতে হয়। ফলে কোনোটিতেই গুরুত্ব দেয়া সম্ভব হয় না। এ জন্য আলাদা জোন গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই’র বাজেট ও করবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হুমায়ুন কবীর বলেন, এনবিআর আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে যে সাফল্য দাবি করে তাতে বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব সবচেয়ে বেশি। আয়করের প্রায় ৬০ শতাংশ নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে বেসরকারি খাতে আদায়ের পর তা সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে। অথচ বিনিময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। এ অর্থ এনবিআরকে আদায় করতে হলে বর্তমান কাঠামোর চেয়ে দ্বিগুণ লোকবল নিয়োগ দিতে হতো।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি