নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের শ্রম আইনে দৈনিক কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা নির্ধারিত থাকলেও অন্তত ৮০ শতাংশ শ্রমিককে তার বেশি সময় কাজ করানো হয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।
মে দিবসের আগে পাঁচটি শ্রমঘন খাতের শ্রমিকদের কাজের তথ্য বিশ্লেষণ করে রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে আসা প্রতিষ্ঠানটি। নিরাপত্তাকর্মী, পরিবহনকর্মী, হোটেল/রেঁস্তোরা শ্রমিক, রি-রোলিং মিলের শ্রমিক এবং হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শ্রমিকদের নিয়ে এই গবেষণাটি চালায় বিলস।
বিলস কার্যালয়ে ‘শ্রম পরিস্থিতি-২০১৬ : শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দূরপাল্লার পরিবহন খাতের শতভাগ শ্রমিকই দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এছাড়া রি-রোলিং এর ৯২ ভাগ, হোটেলের ৯৮ ভাগ, হাসপাতালের ৪২ ভাগ ও নিরাপত্তাকর্মীদের ৮০ ভাগ শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এসব শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ছুটি থেকেও বঞ্চিত হন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
নিরাপত্তাকর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না; ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে ছুটি পান না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। পরিবহন শ্রমিকদের ৯০ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, ৯৮ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে, ৮৪ ভাগ মে দিবসে ছুটি পান না। হোটেল শ্রমিকদের ৮৬ শতাংশ সাপ্তাহিক ছুটি, ৮২ শতাংশ সরকারি ছুটি ও ৮২ শতাংশ মে দিবসের ছুটিতেও কাজ করেন।
বিলস বলছে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়
রি-রোলিং শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের কাজ করতে হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসেও। হাসপাতালের শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ সরকারি ছুটিতেও কাজ করেন, সাপ্তাহিক ছুটি নেই ২২ শতাংশের। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিরাপত্তাকর্মীদের ৮ শতাংশ নারী। ১৮ বছরের কম বয়সী শতকরা ৪ শতাংশ। আর এ খাতের ৮২ ভাগ শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণির নিচে। এ খাতের ৫৮ শতাংশ শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্র নেই। ৮২ শতাংশ শ্রমিকের বেতন ১০ হাজার টাকা বা তার বেশি।
পরিবহন খাতের শ্রমিকদের শতভাগই পুরুষ। যাদের ৬৪ ভাগের পড়াশুনা প্রাথমিক বা তারও নিচে। ১৮ বছরের নিচে শ্রমিক রয়েছে ৪ ভাগ। চুক্তির ভিত্তিতেই কাজ করেন ৯৪ ভাগ পরিবহন শ্রমিক, যাদের ৯২ ভাগের মাসিক বেতন গড়ে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, হোটেল শ্রমিকদের ২২ শতাংশ নারী। তাদের ৬ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী। এই শ্রমিকদের ৪৪ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। এই খাতের ৯০ ভাগ শ্রমিকের বেতন সাড়ে ৭ হাজারের মধ্যে, যাদের ৩৪ ভাগ কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে।
ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় পাঁচটি খাতের প্রতিটির ৫০ জন করে সর্বমোট ২৫০ জন শ্রমিকের উপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এই গবেষণা চালায় বিলস।
মে দিবসে শ্রমিক শোভাযাত্রা করে অনেক সংগঠন, কিন্তু সে দিনও কাজ করতে হয় অধিকাংশ শ্রমিককে
অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার বিষয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ২৮ জন নারীসহ কর্মক্ষেত্রে ৬৯৯ জন শ্রমিক নিহত হন। এছাড়া আহত হন ৭০৩ জন শ্রমিক। অন্যদিকে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৮৯ জন শ্রমিক,যার মধ্যে নারী শ্রমিক ছিলেন ৪০ জন। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নারীসহ ১৪৯ জন শ্রমিক নিহত হন।
বিভিন্ন কারখানায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ২৩৭টি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ অনুষ্ঠানে বলেন, “শ্রম নিরাপত্তার যে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তা জীবনের নিরাপত্তার না; ব্যবসার জন্য করা হয়েছে। এই উন্নতি করা হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যকে নিরাপদ করার জন্য।
“আইন সব জায়গায় সমান হওয়া উচিত। কারণ জীবনের নিরাপত্তাকে কখনেও ভাগ করা যায় না। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য শ্রমিকদের এক ধরনের নিরাপত্তা, আর প্রান্তিক শ্রমিকের জন্য আরেক ধরনের নিরাপত্তা থাকতে পারে না।”
শ্রমিকদের নিরাপত্তায় অবহেলার জন্য কঠোর শাস্তি প্রয়োগের আহ্বানও সরকারকে জানান সুলতান উদ্দিন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ লেবার রাইটস জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি কাজী আব্দুল হান্নান, বিলসের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর কোহিনূর মাহমুদ ও নাজমা আক্তার, ইনফরমেশন কো-অর্ডিনেটর ইউসুফ আল-মামুন, রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর মনিরুল ইসলাম।