২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:২৬

ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

ফাত্তাহ তানভীর মোঃ ফয়সাল রানা

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো আমাদের দেশেও ধর্ষণ ব্যধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। চলন্ত বাস, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র, থানা, এমনকি আত্মীয়ের বাড়ীও নারীর জন্য নিরাপদ নয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময়, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় সবসময়ই সুযোগসন্ধানীরা সক্রিয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দিতে এসে ধর্ষকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। প্রিয় স্বদেশ কি তাহলে নারীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণকে উস্কে দিচ্ছে। থানার পরিবেশ নারীবান্ধব না হওয়া, পুলিশ-ডাক্তার-আইনজীবীদের ধর্ষিতার সাথে মানবিক আচরণ না করা, সময় সাপেক্ষ আইনী পদক্ষেপ, ঘনিষ্ট আত্মীয়দের লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকায় ধর্ষিতাকে কোণঠাসা করে ফেলে। স্বল্পশিক্ষিত ধর্ষিতা নারী ভাবেন বিচার পাবেন কি? সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যস্থতার প্রলোভন আর কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবার ভয়; তখন ধর্ষিতা বিচারহীনতাকে নিয়তি ভাবতে শুরু করে। বার বার মনের গভীরে একটা ভাবনার জš§ হয়, আমরা গরীব; গরীবের বিচার আল্লাহ দেবেন। আর, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলোর ভূমিকা নীরব থাকে। সঠিক পদক্ষেপের অভাবে ধর্ষিতা বিচার বঞ্চিতই রয়ে যায়। সমাজের অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে, লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই মুখ খোলেনি, খুললেও মিডিয়ায় আসেনি। রাষ্ট্র মানবিকভাবে ধর্ষিতার পাশে দাঁড়ায়নি। এই বিচারহীনতার পেছনে সমাজপতিদের প্রভাব থাকে যথেষ্ট। একজন ধর্ষক মরিয়া হয়ে ওঠে যে কোন মূল্যে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। একবার কোনমতে বেঁচে যাবার মানে হল নতুন ধর্ষণের প্রস্তুতি। আর, এই বিচারহীনতা দেখে উৎসাহিত হয় অন্যরা।
নারী প্রকৃতিগতভাবেই নিজকে রক্ষাকার্যে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে; তাই নরপশুরা পারিবারিক শত্রুতার জের মেটাতে অনেক ক্ষেত্রেই নারীধর্ষণকে বেছে নেয়।
যারা ধর্ষণ করছে তারা অবশ্যই মানসিক বিকারগ্রস্ত, হতাশাযুক্ত; অনেক ক্ষেত্রেই নেশায় আসক্ত। তারা কতটা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ তা’ নিয়েও সংশয় আছে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, নেশায় আসক্ত, হতাশাগ্রস্ত একজন লোভী পুরুষের পক্ষেই নৃশংসভাবে ধর্ষণ করা সম্ভব। ধর্ষক নারীকে সম্মান করেনা, মানুষকে মানুষ ভাবেনা; মানবীয় গুণাবলী তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। মেয়েদের অসচেতনতা, উগ্র পোষাক আর অসংযত আচরণও ধর্ষণের কারণ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে।

কাছের মানুষ দ্বারা নারী-কন্যাশিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাই আপাততঃ নারী-শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভাবাটা বেশি জরুরী। বাবা-মা’র অনুপস্থতিতে শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখা যেতে পারে। সচেতন-সতর্ক থেকে, আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে, ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করে ধর্ষণ প্রতিকার করা যেতে পারে। কিন্তু, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।
আমাদের দেশে ধর্ষণ সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। শুধুমাত্র বিশেষ ট্রাইবুনালে দ্রুত বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করে কখনই এর সমাধান বয়ে নিয়ে আসতে পারবে না। এই ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে হবে। মূলতঃ সচেতনতা-প্রতিবাদ, পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়া, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, নারীর প্রতি সবার সম্মান বৃদ্ধিই পারে এই প্রবণতা রোধ করতে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। এই আন্দোলনে পরিবারের-সমাজের ছোট-বড় সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নারীদের চলাফেরার সময় আরো সতর্ক হতে হবে, সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে। জানতে হবে ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত বিধানগুলো। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলোর ভূমিকা আরো কার্যকর করতে হবে, ধর্ষিতার সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে, থানা-বিচারালয়-হাসপাতাল নারীবান্ধব পরিবেশ হওয়া বাঞ্চনীয়। সাংবাদিকদের ধর্ষণের সংবাদ পরিবেশনের সময় অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং সহনশীলতা ও কৌশলের পরিচয় দিতে হবে; যা অবশ্যই ধর্ষণকে নিরুৎসাহিত করে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কয়েকটি টোল ফ্রি হেল্প লাইন (১০৯, ৯৯৯, ১০৯৮) কাজ করে যাচ্ছে; এইগুলো সম্পর্কে জানতে হবে , জানাতে হবে সবাইকে।
কোন দেশের ধর্ষণ বেড়ে যাওয়া তার দুর্বল আইন ব্যবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়কেই ইঙ্গিত করে। আসুন আমরা ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করি এবং দেশের সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী ও শিশু ধর্ষণের মত গর্হিত কাজকে সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটন করি। প্রতিজ্ঞা করি আমরা আমাদের আর কোন বোনকে ধর্ষিত হতে দেব না।

প্রকাশ :অক্টোবর ৫, ২০১৭ ৩:২৪ অপরাহ্ণ