কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া, (কক্সবাজার) :
ছেলেকে কোলে নিয়ে মিনারা চার বছর আগে মিয়ানমারের মংডু জেলার ধুমবাইয়ের পল্লি চিকিৎসক আয়াতুল্লাহর সঙ্গে বিয়ে হয় মিনারা বেগমের (১৮)। বিয়ের এক বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে এক শিশুসন্তান। স্বামী-ছেলেকে নিয়ে সুখেই কাটছিল মিনারার দিন। সেই স্বামীকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছে মিনারা। শুধু তাই নয়, স্বামীর রক্তাক্ত নিথর দেহ ফেলে একমাত্র ছেলের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসতে হয়েছে মিনারাকে। স্বামীর দেহ ছুঁয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলারও সময় পায়নি সদ্য কৈশোর পেরোনো এই তরুণী। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে ঠাঁই হয়েছে। নিজের ও সন্তানের আহার জোগাড়ের চিন্তায় সময় কাটে তার। এর মাঝে একটু অবসর পেলেই স্বামী হারানোর ব্যাথা তাড়িয়ে বেড়ায় জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া মিনারাকে। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) কথা হয় এই তরুণীর সঙ্গে। মিনারা জানান, কোরবানি ঈদের আগের দিন ২৫ আগস্ট ভোরে তাদের পাড়ায় আক্রমণ চালায় সেনাবাহিনী। এসময় অন্যদের মতো স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন আয়াতুল্লাহও। পথে তাদের ধরে ফেলে সেনাবাহিনী। পাড়ার সবার সামনে আয়াতুল্লাহর মাথায় প্রথমে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আয়াতুল্লাহ। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। সবার সামনে আয়াতুল্লাহর গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করা হয়। এসময় হত্যাকারীরা বলছিল-‘এখানে থাকলে সবাইকে গুলি করবো, কেটে ফেলবো, সবাই বাংলাদেশে চলে যাও।’
মিনারা বলতে থাকে, ‘সবাইকে ভয় দেখানোর জন্য সেনাবাহিনী আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। তারা বুঝিয়ে দিচ্ছিল-তোমরা বাংলাদেশে যাবে কিনা বলো, এখানে থাকলে তোমাদেরও এ অবস্থা হবে। ছেলেকে বাঁচাতে স্বামীর লাশ রেখে পালিয়ে আসতে হয়েছে। প্রথমে ছেলেকে নিয়ে ৩ ঘণ্টা ধানখেতে লুকিয়ে ছিলাম। তারপর পেছনের পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলাম আরও একদিন। পরে সবার সঙ্গে ৯ দিন ধরে হেঁটে ৩ বছরের ছেলেকে বুকে নিয়ে উখিয়ার বালুখালী দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি। ’ ওপারে পয়সাওয়ালা ছিলেন উল্লেখ করে মিনারা বলেন, ওখানে আমাদের তিনটা গরু ছিল, নিজেদের জমি ছিল, সেখানে আমার স্বামী চাষাবাদও করতো। কোন অভাব ছিল না। ওখানে আমরা পয়সাওয়ালা ছিলাম। আসার সময় ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সব পথখরচে চলে গেছে। এখন আমাদের কিছুই নেই। আমরা নিঃস।
স্বামীর শোকে কাতর এই তরুণী বলতে থাকেন, ‘স্বামীর জন্য একটু চোখের পানি ফেলার সময়ও পাইনি। তার আগেই জান হাতে নিয়ে চলে আসতে হয়েছে। ওনার জন্য অনেক খারাপ লাগে। যখন অন্য মেয়েদের স্বামীদের দেখি ত্রাণ নিয়ে আসতে, বউয়ের জন্য অন্য জিনিস নিয়ে আসতে, তখন অনেক কষ্ট হয়। মনে হয় আমার তো কেউ নেই, কোন অভিভাবক নেই। আমি একা। তখন চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারি না। ’ নিজের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে চান জানতে চাইলে মিনারার উত্তর-‘ওখানে আর ফেরার ইচ্ছা নেই। তবে যদি বাংলাদেশ আমাদের তাড়িয়ে দেয় তখন তো যেতে হবে।’ গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাচৌকিতে একযোগে হামলা চালায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। এর জেরে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলি আর মগদের নৃশংসতার মুখে টিকতে না পেরে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা। বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
দৈনিক দেশজনতা /এনএইচ