নিজস্ব প্রতিবেদক:
আমরা পবিত্র রমজান মাসে যে কাজগুলো করে থাকি বা করা উচিত সেগুলোর মধ্য থেকে কিছু উল্লেখ করা হলো-
* রমজানের চাঁদ দেখা : হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড় (ঈদ করো)।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই চাঁদ দেখা সুন্নত, এটি ইবাদতের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসার প্রতীক। নতুন চাঁদকে হিলাল বলে। প্রথম তিন দিনে হিলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে এই দোয়া পড়া সুন্নত: ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ, হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন, আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৪০০, রিয়াদুস সালেহীন: ১২৩৬)।
* রমজানকে স্বাগত জানানো- রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (মুসলিম)। নবী করিম (সা.) এভাবে রমজানকে স্বাগত জানাতেন : ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (বুখারি)
* রমজানে প্রয়োজন হালাল ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া- সারা বছরের মতো রমজানেও হালাল খাদ্যের আয়োজন করতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবারের বিষয়টিও লক্ষ্য রাখতে হবে। ইফতার ও সাহরির সুন্নত পালন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি যত্নবান থাকতে হবে, যাতে ইবাদতের অসুবিধা না হয়। ইবাদতের অনুকূল ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্নতি লেবাসের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
* রমজানে ওষুধ সেবন- রমজান মাস শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি অন্যতম। রোজা পালন ও তারাবির নামাজ আদায়ের জন্য এই উভয় প্রকার প্রস্তুতি খুবই প্রয়োজনীয়। যারা নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ সেবন করেন, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি নির্ধারণ করে নেবেন। যাদের শারীরিক ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে হয়, তাদেরও সেই উপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে।
* রমজানে ইবাদতের প্রস্তুতি– পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ অবশ্যই মসজিদে জামাতে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। তারাবির নামাজ জামাতে পড়ার জন্য যথা সময়ে মসজিদে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি থাকতে হবে। খতমে তারাবি পড়া সবচেয়ে উত্তম। ইবাদতের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কাজকর্মের রুটিন পরিবর্তন করে পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
* রমজানের পাঁচটি সুন্নত পালন- রমজানের পাঁচটি সুন্নত পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। যথা: (১) সেহরি খাওয়া, (২) ইফতার করা, (৩) তারাবির নামাজ পড়া, (৪) কোরআন তিলাওয়াত করা, (৫) ইতিকাফ করা। যারা কোরআন তিলাওয়াত জানেন না, তারা শেখার চেষ্টা করবেন। যারা তিলাওয়াত জানেন, তারা শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করার চেষ্টা করবেন। যারা বিশুদ্ধ তিলাওয়াত জানেন, তারা অর্থ বোঝার চেষ্টা করবেন। যারা তরজমা জানেন, তারা তাফসির অধ্যয়ন করবেন। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত প্রতি সপ্তাহে এক খতম (পূর্ণ কোরআন করিম তিলাওয়াত সম্পন্নকরণ) করতেন—এভাবে প্রতি মাসে অন্তত চার খতম হয়ে যেত।
রমজানের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত হলো ইতিকাফ : রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাহ কিফায়া। এর কম সময় ইতিকাফ করলে তা নফল হিসেবেই গণ্য হবে। পুরুষেরা মসজিদে ইতিকাফ করবেন। নারীরাও নিজ নিজ ঘরে নির্দিষ্ট কক্ষে ইতিকাফ করতে পারবেন।
* রমজানে বিশেষ তিনটি আমল করা : রমজানের বিশেষ তিনটি আমল হলো- (১) কম খাওয়া, (২) কম ঘুমানো, (৩) কম কথা বলা। হারাম থেকে বেঁচে থাকা; চোখের হেফাজত করা, কানের হেফাজত করা, জবানের হেফাজত করা।
রোজা নিয়ে হজরত উম্মে সালমা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস, রমজান আমার উম্মতের মাস।’ হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, যারা রজব মাসে ভূমি কর্ষণ করল না, শাবান মাসে বীজ বপন করল না, তারা রমজান মাসে (ইবাদত ও পুণ্যের) ফসল তুলতে পারবে না।’ নবীজি (সা.) সাধারণত রজব মাসে ১০টি নফল রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি নফল রোজা রাখতেন; যাতে রমজানে ৩০টি রোজা অনায়াসে রাখা যায়। রজব ও শাবান মাসে নবী করিম (সা.) বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তেন। নবী-পত্নী উম্মুল মুমিনীনগণ বলেন, রজব মাস এলে আমরা বুঝতে পারতাম নবীজি (সা.)–এর ইবাদত-বন্দেগির আধিক্য দেখে।
রাসুল (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়বে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের নিয়তে শবে কদরে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
* রমজানের লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করা-রমজান হলো তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। তাকওয়া অর্জনই রমজানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন : ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি। আশা করা যায় যে তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে।’ (সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত)। আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর গুণাবলি অর্জন করে সেই গুণে গুণান্বিত হোক। আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন: ‘আল্লাহর রং! আর আল্লাহর রং অপেক্ষা চমৎকার কোনো রং হতে পারে?’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৩৮)। হাদিস শরিফে আছে : ‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।’ (মুসলিম)। যেহেতু মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি, তাই তাকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে হলে অবশ্যই সেসব গুণাবলি অর্জন করতে হবে।
আল্লাহর রং বা গুণ কী? তা হলো আল্লাহ তাআলার ৯৯টি গুণবাচক নাম। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে : ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে, যারা এগুলো আত্মস্থ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)।
মহান আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ আত্মস্থ বা ধারণ করার অর্থ হলো সেগুলোর ভাব ও গুণ অর্জন করা এবং সেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিজের কাজকর্মে, আচরণে প্রকাশ করা তথা নিজেকে সেসব গুণের আধার বা অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। রমজান হলো তাকওয়ার প্রশিক্ষণ। লক্ষ্য হলো রমজানের বাইরের বাকি এগারো মাস রমজানের মতো পালন করার সামর্থ্য অর্জন করা, দেহকে হারাম খাদ্য গ্রহণ ও হারাম কর্ম থেকে বিরত রাখা এবং মনকে অপবিত্র চিন্তাভাবনা, হারাম কল্পনা ও পরিকল্পনা থেকে পবিত্র রাখা।