২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:২০

বাবা-মা হারানো আসনানরা কান্না ভুলে গেছে

দৈনিক দেশজনতা ডেস্ক:

 

আসনান, বয়স আর কত? বড়জোর চার কি পাঁচ হবে। এরই মধ্যে জীবনে সে যা দেখে ফেলেছে, তা এক কথায় বিভৎস্য। আসনানের বাড়ি হাঁচারবিল গ্রামে। রাখাইন রাজ্যের নাফফুরা জেলার এই গ্রামেও অন্য জায়গাগুলোর মতো মিয়ানমার সেনাবাহিনী মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর চালিয়েছে গণহত্যা। বর্মি বাহিনীর সেই গণহত্যার শিকার হয়েছে আসনানের বাবা। স্বামীর লাশ রেখেই ছোট্ট দুই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন তার মা। আর আসনানকে সঙ্গে নেন নানি।

এরপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারা আসেন নাফ তীরে। অজানা শঙ্কায় পৃথক নৌকায় শুরু করেন দরিয়া পার। কিন্তু, বাংলাদেশের তীরে ‘দুর্ভাগ্যের তরি’ ভেড়ার আগেই সলিল সমাধি হয় আসনানের মা এবং ছোট্ট দুই ভাইয়ের। আসনান এখনও বেঁচে আছে। নানির সঙ্গে থাকা তাদের নৌকাটি নিরাপদে নাফ পাড়ি দেয়। এরপর তাদের আশ্রয় হয় কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে।

সেখানেই বয়স্কা নানির কাছ থেকে আসনানকে বুঝে নিয়েছেন তার ফুফু। এখন তিনিই দেখাশোনা করছেন তাকে। হ্যাঁ, আসনান বেঁচে আছেন, বাবা-মা ছাড়া এ থাকাটা যে কতটা কষ্টের, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে!

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সংঘাতের পর থেকে আসনানের মতো ১৫ হাজারের এতিম শিশু বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছে। যারা এখন সহজ কথায় ট্রমাটাইজড। তাদের কারো চোখে পানি নেই। সারাক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকছে। ক্ষুধা পেলেও কান্না করতে ভুলে গেছে এসব শিশু।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে সীমান্ত অতিক্রম করে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু বাংলাদেশে এসেছে। তারা পুষ্টিহীনতাসহ বিভিন্ন জটিল রোগের হুমকিতে রয়েছে।
সংস্থাটির মতে, সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে অভিভাবক হারা কিংবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুরা, যাদের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় শরণার্থী শিবিরের থাকা রোহিঙ্গা এতিম ও অভিভাবকহীন প্রায় ২১শ’ শিশুকে শনাক্ত করেছে।

এসব শিশুর কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। এমনি কি বাবা-মা দু’জনই নেই অনেকের। আবার অনেক শিশু আছে যাদের বাবা-মা থাকলেও সীমান্তের ওপারে কিংবা এপারে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সমাজ কল্যাণ বিভাগের কর্মীরা জানিয়েছেন, এতিমদের মধ্যে বাবাহীন শিশুর সংখ্যা বেশি। শনাক্ত হওয়ার পর তাদের আপাতত কারো না কারো হেফাজতে দেওয়া হচ্ছে। এমনই বাবা-মা হারা হতভাগা শিশু আসনানের বেঁচে ফেরার গল্প শোনান তার ফুফু ও আরেক রোহিঙ্গা।

তারা জানান, গ্রামে ঢুকে মিলিটারিরা নির্বিচারে গুলি শুরু করলে আসনানের বাবা বাড়িতেই মারা যায়। এরপর টোল-টুপলা নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় তার দুই ভাইসহ মা সাগরে ডুবে মারা যায়। আর আসনান ছিল নানির নৌকায়। এজন্য সে প্রাণে বেঁচে গেছে।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক সার্ভিস বিভাগের উপ-পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, অভিভাবকহারা এসব শিশুর তালিকা তৈরি সম্পন্ন হলে তাদের অধিকার সুরক্ষাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘এসব শিশুর ঠিকভাবে যত্ন নেওয়া না হলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের বিভিন্নভাবে অপরাধে ব্যবহার করা হতে পারে।’

গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রাখাইনের অন্তত ৩০টি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনাক্যাম্পে রোহিঙ্গা যোদ্ধারা প্রবেশের চেষ্টা করে। পরে জঙ্গি দমনের নামে নতুন করে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেনা অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ জানিয়েছে, ৫ লাখ এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ অভিযানে ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহতের খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যদিও মিয়ানমার সরকারের দাবি, নিহতের এ সংখ্যা ৪শ’। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭ ২:১৯ অপরাহ্ণ