নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশী গ্রাহক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎতায়ন বোর্ডের (আরইবি) গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ৯৮ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের প্রায় কোটি গ্রাহকের উপর আসছে বাড়তি বিলের খড়গ। কারণ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চলমান গণশুনানিতে খোদ বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ইউনিট প্রতি দাম সাত দশমিক ১৯ শতাংশ বা ৪৪ পয়সা বাড়ানোর পক্ষে অভিমত দিয়েছে। গতকাল কমিশনের কার্যালয়ে মতামত দেয়া হয়।
তবে আরইবির পক্ষ থেকে বিদ্যুতের দাম ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়ে। বিইআরসির মতামত দেয়ার ফলে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম যে বাড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গণশুনানিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পাশপাশি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এছাড়া ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়। গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুইয়া, আব্দুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর ড. শামসুল আলম। গণশুনানিতে আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন,‘বিদ্যমান পাইকারি ট্যারিফ বিবেচনা করে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়।’ ট্যারিফ বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, জনবল খরচ বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত খবচ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত অপচয় খরচ,পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়েছে।’
আরইবি চেয়ারম্যান জানান, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে নিট খুচরা সরবরাহ ব্যয় ইউনিট প্রতি ছয় দশমিক ৭০ টাকা। বিদ্যমান খুচরা ট্যারিফ ইউনিট প্রতি ছয় দশমিক শূন্য পাঁচ টাকা, ইউনিট প্রতি ঘাটতি শূন্য দশমিক ৬৫ টাকা।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সেবা না বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। এমনিতেই গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরপর রয়েছে লোড শেডিং। তাই দাম না বাড়ানোই উচিত।’
চলতি বছর মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠায় বিতরণ কোম্পানিগুলো। পাইকারি পর্যায়ে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। গ্রাহক পর্যায়ে ডিপিডিসি ছয় দশমিক ২৪, ডেসকো ছয় দশমিক ৩৪, ওজোপাডিকো ১০ দশমিক ৩৬ ও আরইবি ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।
এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ২৮ সেপ্টেম্বর ডিপিডিসি, ২ অক্টোবর ডেসকো, ৩ অক্টোবর ওজোপাডিকো এবং ৪ অক্টোবর নওজোপাডিকোর খুচরা মূল্য পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিষয়ে শুনানির আয়োজন করেছে বিইআরসি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপচয়, অব্যবস্থপনা ও সরকারের ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আর এই পরিস্থিতির দায়ভার গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটা অযৌক্তিক। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বিরূপ প্রভাব পড়বে সবক্ষেত্রেই।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পিডিবির কম দামের বিদ্যুতের উৎপাদন বন্ধ রেখে বেসরকারি কে›ন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। রেন্টাল কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে না। এভাবে অপচয়, অব্যবস্থপনা ও সরকারের ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আর ঘাটতি মেটানোর দায়ভার গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটা যৌক্তিক হতে পারে না।
এদিকে, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। তারা গণশুনানিতে বলেছেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবি যেসব ব্যয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সেগুলোর ভিত্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল কিনে, ভর্তুকিকে ঋণ হিসেবে বিবেচনা করে ও ব্যয়বহুল জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যয় বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের মতে, বাড়তি ও অযাচিত ব্যয় বাদ দিলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বদলে কমবে।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করার দাবিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে স্মারকলিপি প্রদান করেছে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ। গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল এ স্মারকলিপি প্রদান করেন।
নাগরিক সমাজের আহবায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি কী বিরাজ করছে, চলতি বছর হাওর বিলীন, পাহাড় ধস, অতি বৃষ্টি ও অতি বন্যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার ওপর রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা, ইতোমধ্যে বাজারে চালের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে নাগরিক জীবনে এমনিতেই ব্যয়ভার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কারিগরি কারণ দেখিয়ে পিডিবি আরইবিসহ অন্যান্য সংস্থা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষই বৃদ্ধির মূল্যভীতি কারিগরি জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা রাখে না। সাধারণ নাগরিকরা চায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী মূল্যে, যদিও ঘন ঘন লোডশেডিং থাকা সত্তে¡ও বিকল্প সেবা না থাকায় নাগরিকরা নিয়মিত বিল পরিশোধ করে যাচ্ছেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশের নাগরিকরা বিন্দুমাত্র সুবিধা পায়নি। অথচ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এভাবে দিনের পর দিন নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনা না করে বিশেষ শ্রেণির প্ররোচনায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করলে নাগরিকদের মনে বিদ্রোহের সৃষ্টি হতে পারে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ