আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যা দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সোমবার নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদেনে সংস্থাটি আরও বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের জোর করে উচ্ছেদ, খুন, ধর্ষণ ও নিপীড়ন করেছে। এতে সেখানকার অসংখ্য রোহিঙ্গা নিহত ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ এইচআরডব্লিউ’র হাতে এসেছে।
ভবিষ্যতে রাখাইনের মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে সংস্থাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও উদ্বিগ্ব দেশগুলোকে অবিলস্বে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ এবং অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। ইতোমধ্যে জাসিংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রাখাইনে নির্যাতিতদের সহায়তায় ত্রাণ সংস্থাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি এবং পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত আসার জন্য নিরাপদ অঞ্চল (সেইফ জোন) করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এইচআরডব্লিউ মনে করে, রাখাইনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় মিয়ানমারের। এজন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে জাতিসংঘের উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ অদালতকে এ ঘটনায় অন্তর্ভুক্ত করা। সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড পলিসি ডিরেক্টর জেমস রস বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্য থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মমভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাখাইনে গ্রামবাসীকে গণহারে হত্যা করা হয়েছে এবং ঘরবাড়ি ব্যাপকহারে জ্বালিয়ে তাদের চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।’ আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ স্পষ্ট করা আছে- কোনো জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা; হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সন্ত্রাস এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাচুর বিবেচনায় নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড করা।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর এর সবই করেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে উচ্ছেদ করছে। সেনাবাহিনী ও মিয়ানমার সরকারের বিবৃতিতেও তার যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
আইসিসির রোম স্ট্যাচুর সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধ হলো- এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যা জেনেশুনেই কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলা আকারে পরিচালনা করা হয়। এ ধরনের হামলা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় অথবা সাংগঠনিক নীতির অংশ হতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবতাবিষয়ক আইনে বলা আছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ যে কেবল সামরিক হামলার ক্ষেত্রে হবে তা নয়। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধ সশস্ত্র সংঘাতমূলক প্রেক্ষাপটের মধ্যে কিংবা এর বাইরেও হতে পারে। তাছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধ মানে যে কেবল একটি এলাকার গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পরিচালনা করা, তা নয়।
হিউম্যান রাউটস ওয়াচ মনে করে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলা চালিয়েছে। আগেও স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে দেখা গেছে, এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও এর আলামত পাওয়া গেছে তা রাখাইন রাজ্যের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও এর তৎপরতা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
গত ২৫ আগস্ট দ্য আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা রাখাইনে অন্তত ৩০টি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা করলে সংঘাত শুরু হয়। এরপর সন্ত্রাস দমনের নামে অভিযান চালিয়ে সেনা ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ব্যাপকহারে জ্বালিয়ে দেয়, তাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ শুরু করে।
বর্মিসেনাদের দমন-পীড়নের মুখে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা (প্রকৃতপক্ষে ৪ লাখ ৩৯ হাজার) পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এইচআরডব্লিউ বলছে, এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালে উগ্রবাদী বৌদ্ধ এবং রাখাইনের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। তখনও বর্মিসেনারা মানবতাবিরোধী অপরাধের নানা ঘটনা ঘটিয়েছিল। জেমস রস বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিবারের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এসব অপরাধের একটি ধারাবাহিক যোগসূত্র স্পষ্ট। এখন বিশ্বও দেখছে রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তাই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এসব অপরাধের রাশ টানতে জাতিসংঘ এবং এ বিষয়ে উগ্বিগ্ন সরকারগুলোর উচিত তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া।’
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ