২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:৪৪

রোহিঙ্গা নিধনে পশ্চিমা বিনিয়োগ হারাচ্ছে মিয়ানমার

দৈনিক দেশজনতা অনলাইন ডেস্ক:  

পশ্চিমা বিনিয়োগ বিষয়টি ঝুলেই ছিল। রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ইউরোপের দেশগুলো অবস্থান স্পষ্ট করল। তারা নিপীড়ক রাষ্ট্র মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে না। অবশ্য মিয়ানমার চেষ্টা-তদবির কম করেনি। ইয়াঙ্গুনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল গত জুনে ছয়টি ইউরোপীয় দেশ সফর করে। দীর্ঘ আলোচনায় তারা যোগাযোগ, জ্বালানি ও শিক্ষায় ইউরোপের বিনিয়োগের বিষয়ে আশার সঞ্চার করেছিল।

কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমারে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। উল্টো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মিয়ানমারের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা প্রশ্নবাণে বিধ্বস্ত হচ্ছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। এই তেল সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর কয়েক দশক ধরেই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চলছে। সম্প্রতি সেটা অতীতের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

জাতিসংঘ এটিকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে উল্লেখ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে বলা হচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল যেখানেই যাচ্ছে, প্রশ্নবাণে বিধ্বস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইয়াঙ্গুন সিটি ডেভলপমেন্ট কমিটির মহাসচিব হলাইং মাউও তার রয়টার্সকে বলেন, ‘বিনিয়োগ প্রশ্নে প্রত্যেক দেশই এই ইস্যুটিকে (রোহিঙ্গা) সামনে নিয়ে আসছে।’ সম্প্রতি ১৬ দিনের সফর শেষ করে মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ এই ব্যবসায়িক কর্মকর্তা দেশে পৌঁছেছেন।

শুরু থেকেই মিয়ানমারে পাশ্চাত্য বিনিয়োগ খুব কম ছিল। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন চলার কারণে মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু, নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি’র নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গত কয়েক বছরে সে হাওয়াটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। প্রায় সবগুলো নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা পাশ্চাত্য বিনিয়োগের বন্যা আশা করছিল। কিন্তু, চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটে ব্যবসায়িক সুনাম হারানোর আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আইনজীবী, পরামর্শক ও লবিয়িস্টরা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিচ্ছে না। ইয়াঙ্গুনভিত্তিক ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ফেয়ারক্যাপ পার্টনার্সের ম্যানেজিং প্রিন্সিপাল লুইস ইউং জানান, তাদের অংশীদার প্রথম শ্রেণির একটি মার্কিন বেভারেজ কোম্পানি আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মিয়ানমারে ব্যবসা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু, রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং প্রশাসনিক সংস্কারের ধীর গতির কারণে তারা সেই পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। তিনি বলেন, মোদ্দা কথা হল, বিনিয়োগের জন্য এটা সঠিক সময় বলে তারা মনে করছে না। তারা সরকারকে আরও উদ্যোগী দেখতে চায়, কিন্তু, রাখাইনের পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়।’ কেবল সম্ভাব্য উদ্যোক্তা নয়, যারা ইতোমধ্যে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের দিক থেকেও সু চি সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে। অধিকার সংগঠন এএফডি ইন্টারন্যাশনাল ইতোমধ্যে সব বিদেশি কোম্পানিকে মিয়ানমারে ব্যবসা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনের বিনিয়োগকারীদের একটি ছোট গ্রুপ তাদের সর্বশেষ সাধারণ সভায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি প্রত্যাহারের দাবি তুললেও তা পাস করাতে ব্যর্থ হয়। মিয়ানমারে মোবাইল ফোন সেবার ব্যবসায় থাকা নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর সম্প্রতি রাখাইনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিটির চেয়ারম্যান বার্নড ল্যাঞ্জ জানান, তাদের একটি প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, গত সপ্তাহে তা স্থগিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়।’

মিয়ানমার টুরিজম ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান খিন অং তুন জানিয়েছেন মিয়ানমারে কনফারেন্স করার পরিকল্পনা করছিল এমন অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি এখন অন্য দেশের কথা ভাবছে। গ্লোবাল রিস্ক কনসাল্টেন্সি ফার্ম কন্ট্রোল রিস্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান ডেইন শ্যামোরো বলেন, ‘মানুষ সবেমাত্র মিয়ানমারকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছিল। আর এখন কোথাও মিয়ানমারের কথা তুললেই সবাই শরণার্থী আর টিভিতে দেখা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার খবর বলতে শুরু করে।’ অবশ্য এমন পরিস্থিতির কথা সু চিও স্বীকার করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা।

গত এপ্রিলে মিয়ানমার তাদের বহু প্রতীক্ষিত বিনিয়োগ আইন পাস করে। সেখানে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও স্থানীয়দের মত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। বছরের শেষ দিকে আরও একটি আইন পাস হওয়ার কথা, যার মাধ্যমে বিদেশিদের স্থানীয় কোম্পানির শেয়ার কেনার সুযোগ দেয়া হবে। এতসব করেও মিয়ানমারের শেষ রক্ষা হচ্ছে। শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সব বরবাদ হতে বসেছে।

তবে মিয়ানমারের ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কোম্পানি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দপ্তরের উপ-পরিচালক থান অং কিয়াও বলেন, ‘রাখাইনের পরিস্থিতি না বদলালে ইউরোপের বিনিয়োগকারীরা অন্য বিকল্প ভাবলেও ভাবতে পারেন। কিন্তু, এশিয়ার বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমার ছেড়ে যাবেন না বলেই তার বিশ্বাস।’

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

 

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭ ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ