নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রাণ ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে যেসব রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে এসেছেন এখন তাদেরকে ‘যুদ্ধ’ করতে হচ্ছে জীবন ধারণের জন্য। কক্সবাজার আর বান্দরবানে অবস্থানরত নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ যেন সীমা ছাড়িয়েছে। স্বামী সন্তান হারানো অনেক নারী আছেন যাদের বেঁচে থাকার নূন্যতম অবলম্বন নেই। অনেক সন্তান সম্ভবা ও সদ্য প্রসূতি নারীকে একটু খাবারের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ত্রাণের লাইনে কিংবা রাস্তায়।
টেকনাফের নয়াপাড়ায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ত্রাণ বিতরণ স্থলের পাশে ২৫ কেজি চালের একটি বস্তা নিয়ে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বসে ছিলেন নাছিমা বেগম (৬০)। বেলা এগারোটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কাদায় দাঁড়িয়ে থেকে স্লিপের এই চাল সংগ্রহ করেছেন তিনি। এখন এই বস্তা নিয়ে যেতে হবে কমপক্ষে দুই কিলোমিটার দূরে দমদমিয়ায়।
কিন্তু কিভাবে এটা নিয়ে যাবেন- জিজ্ঞাস করতেই জানালেন সুলতান, এহসান উল্যা আর মুজিবুল্লাহ নামে তার তিন যুবক ছেলে ছিল। যাদেরকে রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছে সেদেশের সেনা-পুলিশ। এরপর কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দ মুখ দিয়ে বের করতে পারেননি তিনি।
এখানে ত্রাণ নিতে এসেছিলেন আটমাসের গর্ভবতী নুর হাসিনা। তিনি জানান, সকালে এক মুঠো ভাত খেয়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন ত্রাণের জন্য। ত্রাণের বস্তা যখন হাতে পেয়েছেন তখন বিকেল পাঁচটা। এতক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে কাদা পানিতে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এই বিতরণ কেন্দ্র থেকে গত চারদিন ধরে দৈনিক ১৫০০ পরিবারকে চাল দেওয়া হয়। ওই কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা রেজোয়ানা চৈতি বলেন, ‘আগে থেকেই এই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ছিল। বণ্টনের সুবিধার জন্য সবাইকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। আমাদের স্বেচ্চাসেবকরা সদ্য আসা রোহিঙ্গাদের কাছে গিয়ে রেশন কার্ড দিয়ে এসেছেন। এখানে যে লাইনে আগে আসবে সেই আগে পাবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, উল্লেখ করেন তিনি।
উখিয়া- টেকনাফের পথে পথে এই রকম হাজারো অসহায় নারীর মুখ যেন উপহাস করছে কথিত সভ্যতাকে। এরমধ্যে গা শিউরে উঠার মত পরিস্থিতি গর্ভবতী ও সদ্য প্রসূতি নারীদের। পরিবারের পুরুষ সদস্যের অনুপস্থিতিতে উখিয়ার ঠ্যাংখালি থেকে সাত মাসের গর্ভবতী তসলিমা মারাত্মকভাবে চর্ম রোগে আক্রান্ত দুই শিশুকে নিয়ে দুই কিলোমিটার হেঁটে এসেছেন বালুখালিতে অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আসার পর থেকে তার স্বামী অসুস্থ, ত্রাণ সংগ্রহ কিংবা অন্য কোনো কাজে তিনি বের হতে পারেননা। খাবার ও ত্রাণের আশায় তাকেই আসতে হয়। ছেলে দুটি মারাত্মক চর্ম রোগে আক্রান্ত। এক ঘণ্টার বেশি সময় হেটে ক্যাম্প পর্যন্ত এসেছেন। এই ক্যাম্পে গত এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন ঢাকার ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসক ও ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর মহাসচিব এজেডএম জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এমন অনেক গর্ভবতী ও সদ্য প্রসূতিরা চিকিৎসা নিতে আসছেন যারা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। গর্ভবতী এমন অনেক নারী চিকিৎসা নিতে আসছেন যাদের নিজেদের হাটার শক্তি নেই উল্টো কোলে করে অন্য সন্তানকেও নিয়ে আসছেন।’ এর আগে গত বুধবার বিকেলে বালুখালি এলাকায় রেহানা নামের সন্তান সম্ভবা এক রোহিঙ্গা নারীকে দেখা গেলো না খেয়ে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকতে।
জাতিসংঘের আন্ত: সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপের মতে চরম অপুষ্ঠিজনিত ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজার। এখন ত্রাণ সংগ্রহ ও চিকিৎসা সেবা পেতে নারীদেরকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থাগুলোকে এই দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ