নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর সরকারি-বেসকারি হাসপাতালের বাইরে প্রতিদিনই দেখা যায় সারিসারি মোটরসাইকেল। প্রথম দেখে যে কেউ বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে পারে, হাসপাতালে এত মোটরসাইকেল কেন? আসলে সেগুলো ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেল। হাসপাতালের বারান্দা, করিডর, রোগীদের বসার জায়গা, চলাচলের জায়গা-সবখানেই এই প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণ।
বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ভোর থেকে শুরু হয় তাদের পদচারণ। যত্রতত্র ঘুরাঘুরি, দল বেঁধে রোগীদের চিকিৎসাপত্র স্মার্টফোন দিয়ে ছবি তুলে নেওয়া এবং চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাই তাদের প্রধান কাজ। ডাক্তাররাও নানা রকমের উপটোকনের আশায় তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। পিকআওয়ারে রোগীদের চেয়ে এই বিক্রয় প্রতিনিধিদের বেশি সময় দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিদিনই দুর্ভোগে পড়েন। মাঝেমধ্যে রোগীদের সঙ্গে নানা ইস্যু নিয়ে বাকবিতণ্ডাও হয়। বারবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এমনভাবে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করছেন, যেন হাসপাতালগুলো ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের হাট!
গত কয়েক মাসে রাজাধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড, ক্যানসার, যক্ষ্মা হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিকস (পঙ্গু হাসপাতাল) ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোয় দেখা যায়, চিকিৎসকদের উপঢৌকন দিতে নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তা ছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের সামনে ও ভেতরেও জটলা পাকিয়ে নিয়মিত আড্ডা জমান। পাশাপাশি নিজেদের ওষুধ বিক্রি বাড়ানোর জন্য প্রতিনিধিরা ডাক্তারদের নানাভাবে প্ররোচিত করেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ওষুধ বিক্রি করে ব্যক্তিগত লাভের আশায় চিকিৎসকদের উপটোকন, কমিশনসহ প্রণোদনা দিচ্ছে। এসব বিক্রয় প্রতিনিধি তুলনামূলক নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
নামসর্বস্ব ওষুধ কোম্পানিগুলো যেমন তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখছে, তেমনি লোভনীয় কমিশনের ফাঁদে পড়ে এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসকরাও গুণমানহীন বেনামি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লিখে প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছেন। অনেকে গাড়ি-বাড়ি করছেন বলেও জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শুধু ঢাকা মেডিক্যালেই প্রতিদিন ওষুধ কোম্পানির প্রায় ৩০০ ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধি কাজ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ডায়াগনিস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারের শতাধিক বিক্রয় কর্মকর্তাও রয়েছেন, যারা হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত উৎকোচ দিয়ে থাকেন।
এ ছাড়া বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালকে কেন্দ্র করে শাহবাগের শহীদ জিয়া শিশুপার্কের সামনের জায়গা দখল করে দুই শতাধিক বিক্রয় প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেল রাখতে দেখা যায়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ২৭৮টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৬৬টি ইউনানি, ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩২টি হার্বালজাতীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রায় ৭০ হাজার মেডিক্যাল প্রতিনিধি বিস্তৃত জালের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এদের মাধ্যমেই কোম্পানিগুলো নিজেদের ওষুধ বাজারজাতকরণে ডাক্তারদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন। মেডিক্যাল প্রতিনিধিরা চিকিৎসকদের প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র ও প্রেসক্রিপশন মনিটরিং করেন। অভিযোগ আছে, বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ওষুধ বিক্রির ওপর মাসিক সম্মানী ও বাড়তি মুনাফার রীতি চালু থাকায় নানা ধরনের অসৎ উপায় অবলম্বন করে থাকেন তারা। এ ছাড়া ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিরা পদোন্নতির আশায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রস্তাব ও টার্গেট পূরণে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ দারোয়ানদের পর্যন্ত পকেট ভারী করেন। আবার অনেকে রোগীদের বেডে বেডে গিয়ে ব্যবস্থাপত্র দেখেন, বিক্রি করেন নিজস্ব কোম্পানির ওষুধ।
পরিপাটি পোশাক, স্মার্ট ভঙ্গিতে ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে ওত পেতে থাকেন, কখন ডাক্তারের কক্ষে ঢুকবেন। অনেক রোগী আবার এদের ডাক্তার ভেবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। গত ২৮ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মেডিক্যালের মেডিসিন ওয়ার্ডে একটি কোম্পানির এক মেডিক্যাল প্রতিনিধি ডাক্তারদের রুমে স্যান্ডউইচ ও বিস্কুটের প্যাকেট দিতে দেখা যায়। জানতে চাইলে কোম্পানির নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপস্থিত মার্কেটিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ওষুধ লেখার বিনিময়ে শুধু বিকেলের নাশতাই নয়, দামি ওষুধের অনেক স্যাম্পল, চিকিৎসকের স্ত্রীর গহনা, সন্তান ও পরিবারের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস, ভ্রমণের টিকিটসহ অনেক কিছুই তারা চেয়ে নেন। এভাবে বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে তারাও এমন সুবিধা পান বলে জানান তিনি। ওষুধ প্রতিনিধিরা জানান, ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজে না।
গত ঈদে ঢাকা মেডিক্যালসহ ঢাকার কয়েকটি নামিদামি সরকারি-বেসরকরি হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালসমূহে পছন্দের চিকিৎসক এবং ডিসপেন্সারি মালিকদের কোম্পানরি পক্ষ থেকে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঈদ, পূজা ও পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবে নিয়মিমত সুগন্ধি চাল, চিনি, সেমাইসহ অনেক কিছুই দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিউজ্জামান বলেন, একটা নতুন পণ্য বাজারজাত করার জন্য প্রতিনিধিরা ডাক্তারদের কাছে যান। একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালে তারা ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু উপহার বা প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই। কিছুদিন আগে ওষুধের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সরকার ৬২টি কোম্পানির বিভিন্ন আইটেমের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে বলে জানান তিনি।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ