আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
স্বামী বদিউর রহমানের বয়স ১০০ পেরিয়েছে। স্ত্রী মোস্তফা খাতুনের বয়সও কম নয়, অনেক আগে ৭৫ পেরিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে বৃদ্ধ স্বামীকে খাওয়াচ্ছিলেন বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গা নারী। সম্ভবত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এটাই তাদের শেষ খাবার। এই দম্পতিকে দুপুরের মধ্যেই বাংলাদেশের মাটি ছাড়তে হবে। বদিউরদের মতোই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বেঁচে যারা বাংলাদেশের মাটিতে নিরাপত্তা খুঁজেছিলেন, দুপুরের আগেই তাদের চলে যেতে হবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার কাঁটাতার বরাবর, নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। এই কাঁটাতারের বেড়ার ওপারেই রোববার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সশস্ত্র মহড়া দিয়েছিল। এমনকি ঘনঘন হেলিকপ্টার নিয়ে মহড়া দিয়ে নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীকে আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। বদিউর জানালেন, সকাল থেকেই তাদের ওপর বেশ চাপ বাড়ছে, বাংলাদেশের ভূমি ছেড়ে দিতে হবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাপ আরও বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার সকাল থেকে সেখানকার সব অস্থায়ী ঘর তুলে ফেলা হয়েছে।
সকাল থেকেই পলিথিন দিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী ছাউনি তুলে কাঁটাতারের দিকে রোহিঙ্গাদের যেতে দেখা গেছে। নারী-পুরুষ, শিশু সবাই আতঙ্কিত অবস্থায় চলে যাচ্ছেন সেই লাইন বরাবর, যার ওপারেই তাদের জন্য ভয়ঙ্কর মিয়ানমার সেনাবাহিনীঅপেক্ষা করছে। ‘আমার বাপ আবদুস সলাম ও বড় ভাই রাইত আলমকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। জান বাঁচাতে আমরা এখানে এসেছি। এখন আমাদের আবার ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুর দিকে’, বললো শফি আলম। ১৫ বছরের এই কিশোর ভাষ্য, রাখাইনে সেনাবাহিনী গুলি করার পর জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করছে । একের পর এক ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘মেয়েদের বেইজ্জত করছে’ ক্ষুব্ধ এই কিশোর এভাবেই বলল সেখানে নারীদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জুলুমের কথা। ‘এখন কাঁটাতারের বেড়ায় থাকতে ভয় হচ্ছে। ওরা হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করতে পারে’, এভাবেই আশঙ্কা প্রকাশ করে।
চলতি মাসের শুরুতে রাখাইনে মিয়ানমার সরকার সেনা মোতায়েন করে অভিযানের ঘোষণা দেয়। এরই মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর বদলা নিতেই রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ পোস্টে হামলা ও একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ হয়। গত বছরের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো মিয়ানমার সেনাদের এমনই এক হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বৃহস্পতিবার তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কমিশন রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের আহ্বান জানায়। প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নতুন করে হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমার। এই সংঘর্ষে মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১০৪ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ১২ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। তবে রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের দাবি, নতুন করে ৮ শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।
আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ) এক টুইট বার্তায় এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে এআরএসএ জানায়, তারা ২৫টির বেশি এলাকায় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সংগঠনটি দাবি করে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় রাথেতুয়াং শহর এলাকা গত দুই সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ। সেখানে রোহিঙ্গারা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। মাউংদোতেও তারা যখন একই কাজ করতে যাচ্ছিল, তখন বার্মিজ উপনিবেশিক বাহিনীকে হটাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছি। বরাবরের মতো গত বছরের অক্টোবরে এ ধরনের সংঘর্ষের পর প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। পরে তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।
বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পরও একইভাবে স্রোতের বেগে সীমান্তে আসছে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত। এসব এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনী বিজিবির কড়া নজরদারি থাকা সত্ত্বেও তারা রাতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা পাঁচ রোহিঙ্গা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মুসা ও এয়াকুব। বাংলাদেশে আসার পথে মারা গেছেন হাফেজ হারুন। আরও দু’জন বাংলাদেশে আসার পথে নিহত হন। এলাকাবাসীর ধারণা, অন্তত ৩ থেকে ৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি