শিল্প–সাহিত্য ডেস্ক:
এ যাবত শতাধিক বাঙালি ঐতিহাসিক একাধিক ইতিহাস গ্রন্থ লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ের পটভূমিতে গ্রন্থ রচনা করেছেন আরো অনেক ইতিহাসবিদ। মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড, কেউবা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখেছেন। এসব বিস্মরণ হবার মতন নয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে যারা ঐতিহাসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ইতিহাস লিখে এরা স্মরণীয় হয়ে আছে।
রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) কলকাতায় ভূমিষ্ঠ হন। ঐতিহাসিক ও সিভিলিয়ান। তার পিতা ঈশানচন্দ্র প্রজাবিদ্রোহের নেতা ছিলেন। রমেশচন্দ্র স্কুলের উপযোগী করে বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাস লিখেছেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে আইসিএস পাস করে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে উচ্চপদে চাকরি করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ। বিলাত প্রবাসকালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অধ্যাপনা করেন। চালিয়ে যান ভারতীয় ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা। ১৮৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে পাবনায় প্রজাবিদ্রোহ শুরু হলে ভূমিতে প্রজার স্বত্ব নিরূপনের জন্য ARCYDAE ছদ্ম নামে বেঙ্গল ম্যাগাজিন পত্রিকায় অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখেন ইংরেজিতে। তার লেখা গবেষণামূলক ইতিহাসগ্রন্থ England and India Arecord of proyress during of Bengol. Famines and Land Assessments in lndia গ্রন্থ ভূমি রাজস্বের অপব্যবহারের সমালোচনা করেন। Economic History of British india গ্রন্থে সরকারের ভারত শোষণ পদ্ধতি উদঘাটিত করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে civillsation in Ancicnt India. তিনি কয়েকটি বাংলা গ্রন্থও লিখেছেন। বঙ্গবিজেতা, মাধবী কংকন, মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত, রাজপুত জীবন সন্ধ্যা, সংসার, সমাজ প্রভৃতি। এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকাতেও (১৯০২) তার লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ আছে। ভারতের বরোদায় তার জীবনাবসান ঘটে রাজমন্ত্রী থাকাকালে।
রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০) জন্ম ঢাকার তেওতা এলাকায়। কলিকাতার সংস্কৃত কলেজে এন্ট্রাস শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। অসুস্থতার জন্যে পড়া হয়নি। গ্রহণ করেন লেখকের জীবিকা। বাংলা রচনায় এতদূর পারদর্শী হন যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এফএ ও বিএ পরীক্ষায় বাংলা রচনার পরীক্ষার নিযুক্ত করেন। লিখতেন এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় ঐতিহাসিক প্রবন্ধ। তার লেখা ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ (৫ খণ্ড) বাংলায় ঐতিহাসিক সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তার রচিত ‘দেশীয় মুদ্রাযন্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব ‘পুস্তিকায় ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাস পাওয়া যায়।
অক্ষয় কুমার মৈত্র (১৮৬১-১৯৩০) নদীয়ার সিমলায় ভূমিষ্ঠ হন। রাজশাহী কলেজ থেকে বিএল পাস করেন। ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লেখার জন্যে খ্যাতিমান হন। সিরাজ উদ্দৌলা (১৮৯৮) ও মীর কাশিম (১৯০৬) তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বিজ্ঞান সম্মতভাবে বাংলা ভাষায় ইতিহাস রচনার তিনিই পথিকৃৎ। এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সভায় (২৪.৩.১৯১৬) অন্ধকূপ হত্যা কাহিনি মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। প্রাচীন ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহের জন্য দীঘাপাতিয়ার কুমার শরৎ কুমার রায় প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র অনুসনধান সমিতির প্রধান সহায়ক ছিলেন। গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক ১৯১২) রচনা করে গবেণার পথ সুগম করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ঢাকার সুয়াপুরে ভূমিষ্ঠ হন। পিতা ঈশ্বর চন্দ্র সেন। খ্যাতনামা ইতিহাসকার। গবেষক ও পন্ডিত। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে অর্নাসসহ বিএ পাশ করেন। তিনিই প্রথম বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে বাংলা সাহিত্যের গবেষণা করেন। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ তার অমর কীর্তি। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সুবাদে তার সাহায্যেই স্যার আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেন। তার গবেষণা গ্রন্থ: হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (২ খণ্ড), দি বেঙ্গলি রামায়নস, রামায়নী কথা, বেহুলা, সতী, ফুল্লরা, দি বৈষ্ণব লিটারেচার অফ মিডিয়েভ্যাল বেঙ্গল, বৃহৎ বঙ্গ প্রভৃতি।
যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) ভূমিষ্ঠ হন রাজশাহীতে। ১৮৯২ তে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পাস করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম অধ্যাপক ভাইস চ্যান্সেলর। ইতিহাসে তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। তিনি কয়েকটি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। ১৯০১ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত তার প্রথম গ্রন্থ হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব (৫ খণ্ড)। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে দি ফল অব দি মুঘল এম্পায়ার। শিবাজী (বাংলা) মিলিটারি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, দি রাণী অফ ঝাঁসি। তিনি রবীন্দ্রনাথের রচনা ইংরেজিতে লিখে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তুলে ধরেন। এ ঘটনা রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের আগের। দেশবাসী তাকে আচার্য হিসেবে বরণ করেছিলেন। তাকে অণুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা।
নলিনীকান্ত ভট্রশালী (১৮৮৮-১৯৪৭) ঢাকার বিক্রমপুরে ভূমিষ্ঠ হন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করে ঢাকা মিউজিয়ামের কিউরেটর পদে নিযুক্ত হন। ক্রোনোলজি অফ আর্লি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সুলতানস অফ বেঙ্গল গ্রন্থের জন্য ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিথ পুরস্কার পান। ১৯৩৪ এ মুদ্রাতত্ব ও মূর্তিতত্ত্বে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি উপাধি পান। ইতিহাসের গবেষণায় তার বেশ খ্যাতি হয়েছিল। বিদ্যালয়ের প্রায় ৪০টি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।
রমেশ চন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) ফরিদপুর জেলার খণ্ডপাড়ায় ভূমিষ্ঠ হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ১ম শ্রেণিতে ২য় হয়ে এমএ পাস করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ঢাকার ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপক জীবনের শুরু। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করে ১৯১৪ থেকে সাত বছর। করপোরেট লাইফ ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া নামক নিবন্ধ লিখে ডক্টরেট পান। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান। উচ্চ শিক্ষা লাভে ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করেন। ভারতী বিদ্যাভবনের উদ্যোগে বিস্তৃতভাবে অনেক খণ্ডে ভারতের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পাদনার কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৫১ থেকে পরবর্তী ছাব্বিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমে ভারতীয় জনগণের সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করেন এগার খণ্ডে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন খণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গদেশের ইতিহাস সম্পাদনা করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তিনি ইংরেজিতে বিস্তারিত আলোচনা করেন হিস্ট্রি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট গ্রন্থে। তার শেষ লেখা জীবনের স্মৃতিদীপে।
সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২) বর্ধমান জেলার গোতন গ্রামে ভূমিষ্ট হন। পিতা হরেন্দ্রনাথ সেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ও ভাষাতত্ত্ববিদ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পাশ করেন। দীর্ঘ ২৮ বছর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (৪ খণ্ড), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, চর্যাগীতি পদাবলী, রামকাথার প্রাক ইতিহাস, কম্পারেটিভ গ্রামার অফ মিডল ইল্ডোএরিয়ান, রবীন্দ্রনাথ ও লোকসাহিত্য, দিনের পরে দিন যে গেল (২ খণ্ড) প্রভূতি।
সুশোভন সরকার (১৯০০-১৯৮২) মেদিনীপুর জেলার কাঁথিতে ভূমিষ্ঠ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ ও এমএ (১৯২৩) পাস করেন। অক্সফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ইতিহাসে ডিগ্রি পান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ১৯২৯ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার নিযুক্ত হন। বাংলার নব জাগরণ নিয়ে ইংরেজিতে যে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন তার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮১) পান। বিজন রায় ও অমিত সেন ছদ্ম নামে Seecopy লিখেছেন রুশ বিপ্লবের পটভূমিকা ও নোটস অন দ্য বেঙ্গল রেনেসাঁস, বাংলার ইতিহাসের ধারা প্রভূতি। তার শেষ গ্রন্থ রবীন্দ্র স্মৃতি।
দুর্গাদাস লাহিড়ী (১২৬০-১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) নদীয়া জেলার চক ব্রাক্ষণগড়িয়া গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন। লেখাপড়া করেছেন কলিকাতা মেট্রোপলিটন কলেজে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে দেশের ধান বিদেশে রপ্তানির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করলেও তার সর্ব প্রধান কীর্তি পৃথিবীর ইতিহাস রচনার প্রয়াস। চতুর্বেদ বাংলা অনুবাদ করাও তার উল্লেখযোগ্য অবদান। স্বাধীনতার ইতিহাস, রাণী ভবানী, শিখ যুদ্ধের ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। ভারত বর্ষের ইতিহাস সাতখণ্ডে সমাপ্ত করেই তার জীবনাবসান ঘটে।
নীহার রঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১) ময়মনসিংহে ভূমিষ্ঠ হন। সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স। ১৯২৬ এ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে ফাইন আর্টস শাখায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। ১৯৩৫ এ ঘোষ ট্রাভেলিং বৃত্তি নিয়ে ইউরোপ যান। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ও লন্ডন থেকে গ্রন্থাগার পরিচালনার ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৩৭-এ দেশে ফিরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন পদে। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বাঙ্গালির ইতিহাস আদিপর্ব গ্রন্থটি। এই গ্রন্থকে পুরস্কার দিয়েই সরকার রবীন্দ্র পুরস্কার এর সূচনা করেন। তার মুঘল পেইনটিং, ইনডিয়ান আর্ট প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
অমলেশ ত্রিপাঠী (১৯২১-১৯৯৮) মেদিনীপুরের দেবক গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করেন। তার স্থান প্রথম। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস বিভাগের প্রধান হন। ১৯৮৬-তে অবসর। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে ট্রেড অ্যান্ড ফাইনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, দি এক্সট্রিসিষ্ট চ্যালেঞ্জ, বিদ্যাসাগর দি ট্রাডিশনাল মর্ডানাইজার, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক প্রভৃতি। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।
সমাজবদ্ধ মানুষের ইতিহাস লিখে এরা স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের দেখানো পথেই হাঁটছেন তরুণ ইতিহাসবিদরা। রচনা করছেন নতুন নতুন গ্রন্থ। ইতিহাস চর্চা ও আস্বাদনের ক্ষেত্রে পাঠকদের বিচারবোধ ও রসানুভূতিকে জাগিয়ে তোলার অনুপম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ ইতিহাসবিদরা।
দৈনিকদেশজনতা/এন এইচ