নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাড্ডা থানা এলাকার আদর্শনগরের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকে একটি পরিবার। তাদের তিন বছর ৯ মাস বয়সী শিশুর আদর করে নাম রাখা হয়ছিলো তানহা। গত ৩০ জুলাই রোববার ওই বাসার পাশের বাসায় জাহেদা আক্তার কলি নামে এক নতুন ভাড়াটিয়া আসে। শিশুটি জাহেদা আক্তার কলিকে আন্টি ডাকত। শিপন(৩৫) ওই বাসাতেই অপর একটি ঘরে স্ত্রী নিয়ে ভাড়া থাকত। তার স্ত্রী একজন পোশাককর্মী। ওইদিন বিকেলে শিশুটি কলির বাসা থেকে শিপনের ঘরের সামনে দিয়ে তার নিজের ঘরে ফিরছিল। এমন সময় শিপন তাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে টানাটানি করে ঘরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। তখন শিশুটি চিৎকার করা শুরু করলে শিপন তাকে গলা টিপে হত্যা করে। পরে শিশুটির লাশ বাসার টয়লেটে ফেলে দেয় শিপন। সন্ধ্যায় স্থানীয়রা টয়লেটের ভেতরে লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। রাতে গ্রেফতার হয় শিপন। দেশে সর্বশেষ আলোচিত শিশু ধর্ষণের চিত্র ছিলো এটি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) তথ্য অনুযায়ী শুধু গত জুলাই মাসেই ৩২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২৯৪ জন শিশু ধর্ষণ এবং ৪৬ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এর মধ্যে ২৪ জন শিশুই প্রতিবন্ধি। এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথও প্রায় দু’জন শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকেই উপলব্ধি করা যায় শিশু ধর্ষণ কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সমাজে।
হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এই শিশু ধর্ষণ চিত্রে যখন হতবাক পুরো জাতি ও দেশ, তখন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর প্রতিরোধে কি ভাবছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এটি শুধু সামাজিক নয়, মানবিক অবক্ষয়ও বটে। আর এ জন্য আকাশ সংস্কৃতি অনেকটা দায়ি আর মাদকের প্রভাবতো আছেই।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয় শিশুদের নিরাপত্তায় সচেতন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিবারকেই বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ, এই ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে হয় আত্মীয়স্বজন, নইলে প্রতিবেশী কেউ। অতএব প্রতিটি পরিবারকেই সচেতন থাকতে হবে তার শিশুটির বিষয়ে। সবসময় সন্তানকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব তার মা-বাবা’র। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের পক্ষে শিশুর ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তবে সচেতনতা বাড়াতে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।
পত্রিকায় পক্রাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিএমবিএস আরো বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে ধর্ষণ ও অন্যান্য সহিংসতার শিকার হওয়া ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী ও শিশু দশটি সরকারি হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে চিকিৎসা নিয়েছে।
এদিকে বিগত কয়েক মাস ধরে শিশুদের উপর যে ধারাবাহিক সহিংসতা ও নির্যাতন চলছে তার অন্যতম কারণ হিসেবে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা(বিএমবিএস)।
শিশুদের রক্ষায় কাজ করা সংগঠন সেভ দ্যা চিল্ড্রেন বলছে, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে শিশুদের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শিশুর প্রতি সব ধরণের সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এসব ঘটনার সাথে জড়িত অপরাধীদের সনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করে দল মতের উর্ধ্বে থেকে সকল ঘটনার দ্রুততার সাথে, সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পদ্রানই কেবল শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। অন্যথায় এ সামাজিক অবক্ষয় কেবল শিশুদের জন্য নয়, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সবার জন্য চরম দূর্দশা আর বিভীষিকা বয়ে আনবে।
এ ক্ষেত্রে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ি করা হচ্ছে তা মেনে নিতে রাজি নন নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। চুমকি বলেন, এসব ঘটনার বিচার হচ্ছে। তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রীতার কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাক্ষীরা আদালতে হাজির হয় না অথবা একসময় বিষয়টি মিটমাট করে ফেলে নিজেদের মধ্যে কিংবা মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলাও হয়ে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। তবে এসব বাদে কোন কারণ থাকলে মন্ত্রণালয়কে অবগত করবেন। আমরা ব্যবস্থা নেব।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ বলছে, শিশুর প্রতি সব ধরণের সহিংসতা বন্ধ, প্রতিরোধ, সুরক্ষা কেবল সরকারের বা কোনো একক গোষ্ঠির দায়িত্ব নয়। এ দায়িত্ব সমাজের প্রতিটি ব্যাক্তির। এ বোধ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করা আজ সময়ের দাবি। এই সামাজিক দায় থেকে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। আমরা এই আন্দোলনের অংশীদার। আসুন সবাই মিলে এ আন্দোলনে শরিক হই।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ এর সদস্যরা হচ্ছে সেভ দ্য চিলড্রেন, এ্যকশন এইড বাংলাদেশ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স এ্যাসেমব্লি, এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন-এডুকো, জাতীয় কন্যাশিশু এ্যডভোকেসি ফোরাম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ