নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রাপ্তির খাতায় কিছু বাকি থাকলেও প্রত্যাশার অনেক কিছুই পেয়েছেন নীলফামারীর বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। বাড়িতে বিদ্যুতের আলো, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবয়েল, নারীদের আয়ের অবলম্বন সেলাই মেশিনও দেয়া হয়েছে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ও বয়স্ক ভাতা দেয়া হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন অনেকে। স্বাস্থ্য সেবায় ক্যাম্পিং ব্যবস্থা, প্রাক-শিক্ষা কেন্দ্র এবং ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে বিলুপ্ত চার ছিটমহলে। কমিউনিটি সেন্টার এবং কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে অধুনালুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য। হয়েছে ডিজিটাল উপ-কেন্দ্র। সেতু নির্মাণ, রাস্তা পাকাকরণ, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য আরো চারটি ব্রিজ নির্মাণ, বিলুপ্ত ছিটমহল সংলগ্ন শহীদ স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দারা এখন চান আরো নতুন কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন। একটি বিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষিত যুবকদের চাকুরি এবং কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দাবি উঠেছে। আলাদাভাবে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলেও ইসলামি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সহজ পদ্ধতিতে পবিত্র কোরআন শরীফ শেখার কেন্দ্র চালু করা হয়েছে বাংলাদেশের নতুন ভূ-খণ্ডে। ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ি ইউনিয়নের অভ্যন্তরে পশ্চিম খড়িবাড়ি গ্রামে যুক্ত বিলুপ্ত ২৮নং ছিটমহল বড় খানকির ফরহাদ হোসেনের ছেলে আনিসুজ্জামান মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি। বিভিন্ন অফিসে গিয়ে সুযোগ-সুবিধার কথা জানতে চাইলে হয়রানি করা হয়। বলা যায়, কোনো মূল্যায়নই করা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার একটি চাকুরি প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়ার কথাও বলেছিলেন, কিন্তু সেটির অগ্রগতি দেখছি না।’ একই এলাকার লিটন মিয়ার স্ত্রী সেলাই মেশিন পাওয়া শাহিদা বেগম জানান, ‘আমরা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। দেশের কিনারে থাকি। সংসারে অভাব লেগেই আছে। সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক কাজ করে টাকা উপার্জন করছি। ‘আমরা যারা নতুন বাংলাদেশি নাগরিক হলাম তাদের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কুটির শিল্প বা গার্মেন্টস করা হলে সেখানে কর্ম করে খেতে পারতাম। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসতো মানুষগুলোর মাঝে।’ ২৮নং বিলুপ্ত ছিটের সভাপতি ফরহাদ হোসেন জানান, ‘শিক্ষা প্রসারে এখানে একটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। সেটি যেন বাস্তবায়ন করা হয়। চাকুরি পাবেন এখানকার ছেলে-মেয়েরা।’উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ফরহাদ বলেন, ‘যা পেয়েছি ভালোই পেয়েছি। দীর্ঘদিনের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে শুরু করেছি। নাগরিক হয়ে পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে- এটাই বড় পাওয়া।’ বিলুপ্ত ৩১নং ছিট নগর জিগাবাড়ির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম জানান, কুমলাই নদীর উপর ব্রিজ প্রয়োজন। ওই পথ দিয়ে শুধু নতুন বাংলাদেশিরাই নয়, সবাই যাতায়াত করছেন। আমি নিজেই ব্রিজের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। ব্রিজটি দ্রুত করা হলে সহস্রাধিক মানুষের উপকার হবে।’ ২৯নং বড় খানকি খারিজা গিতালদহের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশি হয়েছি একমাত্র শেখ হাসিনার কারণে। তার উদ্যোগে ৬৮ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে।’ তিনি বলেন,’ আমরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চাই। জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি অদ্যাবধি। এমনকি নেয়া হয়নি উদ্যোগও। নাগরিক হওয়ার পর ভোট দিতে পারলে সেটি হবে বড় প্রত্যাশা পূরণের একটি।’ গয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরীফ ইবনে ফয়সাল মুন জানান, ‘প্রাক্তন ছিটের মানুষরা এখন আমার ইউনিয়নের নাগরিক। তাদের সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছি গত দুই বছর। প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে আরো করা হবে।’ জানতেই চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রেজাউল করিম বলেন, ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর ২০১৫ সালে সরকারি সব দফতরের সমন্বয়ে আমরা উন্নয়নের চিত্র পরিকল্পনা করেছিলাম। সেটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নীলফামারী জেলার বিলুপ্ত চারটি ছিটমহলই ডিমলা উপজেলায়। এরমধ্যে খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছে ২৮নং বড় খানকি, গয়াবাড়ি ইউনিয়নে ২৯নং বড় খানকি গিতালদহ ও ৩০নং বড় খানকি খারিজা গিতালদহ এবং টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে ৩১নং নগর জিগাবাড়ি ছিটমহল। চারটি ছিটমহলে ১১৯টি পরিবারের নতুন ৫৪৫ জনকে পেয়েছে বাংলাদেশ। ছিটমহল বিনিয়ম হওয়ার পর ২০১৫ সালের ১ আগস্ট দিবসের শুরুতে রাত ১২টা ১মিনিটে নীলফামারীর চারটি ছিটমহলে মোমবাতি প্রজ্জলন, আনন্দ উল্লাস আর জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে নতুন পথচলা শুরু করেন বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষরা।
দৈনিকদেশজনতা/এন এইচ