দেশ জনতা ডেস্ক:
দক্ষিণ কোরিয়ায় গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রত্যাশার ব্যত্যয় ঘটেনি। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বুথফেরত জরিপে ইঙ্গিত মিলছে বিশাল ব্যবধানে জিততে চলেছেন উদারপন্থী প্রার্থী মুন জাএ-ইন। অভিশংসনের মাধ্যমে রক্ষণশীল দলের সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিয়ুন হাইয়ের ক্ষমতাচ্যুতি হওয়ার প্রেক্ষিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পার্ক গিয়ুন হাইয়ের অভিশংসন নিশ্চিত করতে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে বিক্ষোভে নেমেছিলো। গিয়ুন হাই এখন কারাবন্দি। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে অভিশংসিত এই সাবেক প্রেসিডেন্টের বিচার শুরু হবে এই সপ্তাহে। এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামপ্রতিক সামরিক উত্তেজনা। এমনই প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনকে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছিল। লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাবী প্রেসিডেন্টের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে তিনিই হয়তো পারবেন দক্ষিণ কোরিয়ান মিরাকলের পরবর্তী অধ্যায় রচনা করতে।
এতে বলা হয়, দেশটির অপরিপূর্ণ, কর্কশ গণতন্ত্রের জন্য গিয়ুন হাইয়ের কেলেঙ্কারি একটি কঠিন পরীক্ষাই ছিল বটে। আর সে পরীক্ষায় পাস করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। বিক্ষোভে প্রাণ হারায়নি কেউ। আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে গণমাধ্যম। মিডিয়া প্রায়ই সতর্ক পন্থা অবলম্বন করলেও পার্কের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। বান্ধবীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় তথ্য পাচার ও বেসরকারি সংস্থা থেকে অসদুপায় অবলম্বন করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার যে অভিযোগ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে, তা মিডিয়াই সামনে নিয়ে গেছে জোরালোভাবে। তার নিজের দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা সহ বেশিরভাগ আইনপ্রণেতা তাকে অভিশংসিত করার পক্ষে ভোট প্রদান করেন। আর অবশেষে, দেশের সাংবিধানিক কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
পার্শ্ববর্তী দেশ উত্তর কোরিয়ার তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী। ১৯৭০ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল অর্ধেকেরও কম। আর এখন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি নেয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। গত পাঁচ দশকে মাথাপিছু জিডিপি ২০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০০০ ডলারে। মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানে দেশটি অনুদান গ্রহীতা থেকে দাতায় পরিণত হয়েছে। প্রমাণ করেছে যে, ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে। আশি ও নব্বইয়ের দশকের সামরিক শাসন থেকে দেশটির গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের সময় অর্থনীতির অগ্রগতি ছিল তুঙ্গে। একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে দেশটির সাম্প্রতিক এই নজির সকলের জন্য উদাহরণীয়।
তবে এতকিছুর পরেও একটি বিরক্তিকর অনুভূতি রয়েই গেছে যে, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি রাজনীতি। দক্ষিণ কোরিয়ানরা ক্রমেই মোহমুক্ত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের ক্ষুব্ধ ভোটারদের মতো তাদেরও মনে হচ্ছে যে, দেশের রাজনৈতিক কাঠামো তাদের জন্য কাজ করছে না। উন্নতির গতি পিছিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। এমনকি চাকরিরতরাও অনুভব করছেন যে, অভিজাতদের জন্য একধরনের নিয়ম ও বাকিদের জন্য আরেক ধরনের। কঠোর নিয়ম হলো সাধারণ্যের জন্য।
ক্ষতবিক্ষত সিউল
পার্ক গিয়ুন হাইয়ের ক্ষমতাচ্যুতি মোহমুক্ত মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি এনেছে। জনতার সঙ্গে তার সংসপর্শ ছিল না। ছিলেন চাটুকার পরিবেষ্টিত। তার বাবা সামরিক একনায়ক পার্ক চুং হি ১৯৭৯ সালে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত টানা ১৮ বছর দক্ষিণ কোরিয়া শাসন করেছেন। আর চুং হি’র শাসনের মূল ভিত্তি ছিল যেই সামরিক আইন, তার খসড়া তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন গিয়ুন হাইয়েরই চিফ অফ স্টাফ।
আর এত বছর পর, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুন জে-ইন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দেশবাসীকে আরো কম স্বেচ্ছাচারী শাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জিতলে তিনি ব্লু-হাউজ নামে পরিচিত দেশের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে থাকবেন না বা কাজ করবেন না। আরেক উদারপন্থি প্রার্থী আহন চিওল-সু বলেছিলেন, তিনি ব্লু-হাউসকে আরো সংকুচিত করে ফেলবেন এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করবেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ানরা চায় তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আরো প্রতিক্রিয়াশীল হোক। আর সেজন্য দরকার হবে আরো পরিবর্তন।
দক্ষিণ কোরিয়ানদের কাছে পরিচিত ‘ইম্পেরিয়াল বা সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্সিতে’ পরিবর্তন আনার একটা উপায় হচ্ছে সাংবিধানিক সংস্কার। বর্তমানে কোনো প্রেসিডেন্ট মূলত তার নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য ইচ্ছেমতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ বা বরখাস্ত করতে পারেন। ভোটারদের দিকে মনোযোগ দেয়ার উদ্দীপনা তাদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। কারণ, সংবিধান অনুসারে একজন প্রেসিডেন্ট মাত্র এক দফার (পাঁচ বছর) বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টই বিদায়বেলায় থাকেন জনপ্রিয়তার তলানীতে আর কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। দক্ষিণ কোরিয়ানদের উচিত দুই মেয়াদভিত্তিক প্রেসিডেন্সি চালু করা এবং জাতীয় পরিষদের ক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য দুই-তৃতীয়াংশ এমপিদের ভোট ও একটি গণভোটের প্রয়োজন পড়বে- তবে এটি জনগণ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল কমাতে সহায়তা করবে।
পরিবর্তন আনতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও। প্রায় চার-পঞ্চমাংশ দক্ষিণ কোরিয়ানরা মনে করেন না যে তাদের প্রতিনিধিরা সঠিকভাবে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলগুলো ক্রমেই বিভাজিত হয়। সমবেত হয় নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের পাশে। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল এ পর্যন্ত যথাক্রমে ১৪ বার ও ১০ বার নিজেদের নাম পাল্টেছে। একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট থাকলে, রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ব্যক্তিবিশেষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাহন হওয়ার বদলে নিজেদের ধ্যান-ধারণার প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। গণমাধ্যমও সাহায্য করতে পারে। পার্কের বেলায় যেমনটা করেছে, তেমন কি মিডিয়া সকল রাজনীতিককে আরো জোরালোভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।
পার্ক-বিরোধী বিক্ষোভ বহুদিনের উপেক্ষিত আওয়াজকে বের করে নিয়ে এসেছে। অভিশংসন ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে প্রায় ৯ লাখ ২৯ হাজার নাগরিক তাদের এমপিদের কাছে এ বিষয়ে চিঠি লিখেছে। দেশটির ইতিহাসে মানুষের এমন রাজনীতিতে জড়িত হওয়াটা আগে কখনও শোনা যায়নি। দেশের কর্পোরেট ও রাজনৈতিক সার্কেলের মধ্যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি ক্রমেই কমছে। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য স্যামসাংয়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লি জে-ইয়ং বর্তমানে গিয়ুন হাইকে ঘুষ দেয়ার মামলায় কারাগারে বন্দি। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। এটি বেশ বড় অভিযোগ। তার বাবা ও স্যামসাংয়ের মূল চেয়ারম্যান লি কুন হিও ২০০৮ সালে ঘুষের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকে ক্ষমা করে দেন। পার্ক গিয়ুন হাইয়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ক্ষোভ মতাদর্শে বিভক্ত দক্ষিণ কোরিয়াবাসীকে একত্রিত করেছে। উদারপন্থি প্রার্থী মুন জে-ইন নিজের গতানুগতিক ধারা ভেঙে রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থি ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ান মিরাকলের পরবর্তী অধ্যায় রচনার হাতছানি তার সামনে।