নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভারি বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। দিনের পর দিন পানিবন্দি থাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। দুর্গত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই বলে অভিযোগ করেছে বন্যাকবলিত মানুষ। অনেক স্থানে গত চার দিনে ছিটেফোঁটা ত্রাণ পায়নি বানভাসি মানুষ। সেখানে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে ১১ জন আহত হয়েছে। পানি কমতে থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়-ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মার পানি বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মার পানি আগামীকাল পর্যন্ত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি হ্রাস আজও অব্যাহত থাকতে পারে। ৮টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৭৮ সেন্টিমিটার ও সারিয়াকান্দিতে ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া যমুনা সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, ধলেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা ও কংস বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলার ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম সদর, রৌমারী, রাজিবপুরসহ জেলার ৭ উপজেলার ৪০ ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩৭ হাজার পরিবারের প্রায় ২ লাখ মানুষ। অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব এলাকায় খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ১৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। গত ৬ দিন ধরে পানিবন্দি পরিবারগুলোতে খাদ্য ও খাবার পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও হাতে কাজ না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অতি কষ্টে দিন পার করছে। সরকারিভাবে যত্সামান্য ত্রাণ তত্পরতা শুরু হলেও সিংহভাগ লোকের ভাগ্যে তা জুটছে না। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, এ পর্যন্ত মাত্র ৪ মেট্রিক টন চাল পেয়েছি, যা মাত্র ৪০০ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব। অথচ আমার ইউনিয়নে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, বন্যার্তদের জন্য ২৫০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলার ৯ উপজেলায় ৭৭১ হেক্টর জমির আউশ ধান, সবজি, বীজতলা, আখ ও পাটসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। রৌমারী সংবাদদাতা জানান, গতকাল রাতে গাছবাড়ী ও কর্তিমারী এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। গাছবাড়ী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭০ হাত স্কুলগৃহ পানির তোড়ে ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে খাদ্য ও খাবার পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেখা দিয়েছে গবাদি পশুর খাবার সঙ্কটও। রৌমারীর দাঁতভাঙ্গা, বন্দবেড়, চর শৌলমারী, জাদুরচর, শৌলমারী এবং রাজীবপুরের দুই ইউনিয়নের ৬০ ভাগ এলাকায় বন্যার পানি ঢুকেছে। ত্রাণবাহী নৌকা দেখলেই বন্যাকবলিতরা হুমড়ি খেয়ে ছুটে যাচ্ছে ত্রাণের আশায়। পানির মধ্যেই ত্রাণের জন্য হুড়োহুড়িতে অন্তত ১১ জন আহত হয়েছে। কাজাইকাটা গ্রামের আজিরন বেওয়া বলেন, ‘চার দিন ধইরা পানিতে ভাসতাছি। কেই আমগোরে খোঁজ নিছে না। খাইতে পারতাছি না, হুইতে (শুতে) পারতাছি না।’ সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় গতকাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৭৭ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে ধরলার পানি। ধরলার প্রবল স্রোতে সদর উপজেলার শিবেরকুটি এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত একটি বাঁধটি ধসে গিয়ে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অপরদিকে তিস্তার প্রবল পানির স্রোতে আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বালুর বাঁধ ভেঙে নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ’ পরিবার। ফলে নতুন করে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে বিদ্যালয়। এসব এলাকায় মানুষজনের মধ্যে খাদ্য ও পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের মাঝে যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন বন্যাকবলিত মানুষজন। ফলে তারা চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। জামালপুর প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ উপজেলার ১ লাখ ৭২ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি ঢুকে যাওয়ায় জেলায় ১৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি কলেজ, ৩৯টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ১৮টি মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানায়, বন্যার পানি প্রবেশ করায় জেলার সাতটি উপজেলার ২৪৪ হেক্টর জমির আমন বীজতলা, ৭৩৯ হেক্টর জমির সবজি, ৪২৭ হেক্টর জমির আউশ ধান, ১৪৪৭ হেক্টর জমির পাট ও ১০ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল তলিয়ে গেছে। গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের ৭০ হাজার ৯২৯টি পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা বেষ্টিত অন্তত ৭০ চরে ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। এসব চরের বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরপানি হওয়ায় অধিকাংশ পরিবার ডাকাতের ভয়ে গবাদি পশু ও সহায় সম্বল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উঁচু স্থান ও ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চলে গেছে। ফুলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর মণ্ডল জানান, ফুলছড়ি জুনিয়র হাই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া বানভাসিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বালাসিঘাট, সিংড়িয়া, রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত মানুষগুলো জানায়, তারা তিন দিন হল সেখানে এসেছে। কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তারা কোনো ত্রাণ পায়নি। বগুড়া অফিস জানায়, যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বগুড়ার বন্যাকবলিত ৩ উপজেলা সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অনেক এলাকায় খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো গবাদি পশু নিয়ে পড়েছে বিপাকে। কারণ চারদিকে পানি ওঠায় দেখা দিয়েছে গো খাদ্যের সঙ্কট। সিলেট অফিস জানায়, সিলেটের বন্যাপ্লাবিত এলাকার পানি নামছে ধীরগতিতে। পানি কমতে শুরু করায় বিভিন্ন রোগব্যাধি বন্যাকবলিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, তিস্তার পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমারা ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ কমেনি পানিবন্দি মানুষের। এখনও দুই উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ২০ গ্রামের ৫ সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের পূর্বছাতনাই গ্রামে তিস্তার স্পার বাঁধে ৭০০ জনের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম।
দৈনিক দেশজনতা/ আই সি