নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গে লাশ সংরক্ষণের ফ্রিজ, এসি বিকল হয়ে যাওয়ায় লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েছে কর্তৃপক্ষ। মর্গের মেঝে ও ট্রে’তে লাশ স্তুপ করে রাখায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে আশেপাশে। তবুও এ সংকট নিরসনে ঢামেক কর্তৃপক্ষের উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ঢামেক কর্তৃপক্ষ বলছে, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম লাশ না নেয়ায় মর্গে লাশের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, জুরাইন কবরস্থানে জায়গা না থাকায় তারা লাশ নিয়ে দাফন করতে পারছেন না। তাই তারা লাশ নিচ্ছে না এবং নিতেও পারবে না।
ঢামেক ও আঞ্জুমানের লাশ নিয়ে ঠেলাঠেলির কারণে ঢামেক মর্গের এখন বেহাল দশা। লাশের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্গন্ধও। ইতোমধ্যেই মর্গের দুর্গন্ধ এতটা চরম পর্যায়ে যে মর্গ এলাকায় থাকাই দ্বায়।
ঢামেক মর্গের ৫টি ফ্রিজের মধ্যে ২টি মাস দুয়েক ধরে নষ্ট। বাকি ৩টি জঙ্গি, বিদেশি, নবজাতক ও অজ্ঞাত লাশের দখলে। এছাড়া ট্রে’তেও রাখার আর সুযোগ নেই। মেঝেসহ মর্গের সবগুলো ট্রে ইতোমধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে মর্গের ৪টি এসির সব ক’টিই নষ্ট বছর খানেক ধরে। সেখানে নেই আবার পর্যাপ্ত ফ্যান। প্রতিদিন ৮-১০টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ঢামেক মর্গে প্রতি বছর রাজধানীর অধিকাংশ থানা ছাড়াও অন্যান্য এলাকা থেকে আসা তিন হাজারেরও বেশি লাশের ময়নাতদন্ত হয়, যা অন্যান্য মেডিকেল কলেজের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশি। অথচ নষ্ট হওয়া এসব ফ্রিজ ও এসি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।
এদিকে, বেওয়ারিশ লাশগুলোও আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের লোকজন না নেয়ায় গতকাল শনিবার পর্যন্ত মর্গে জমেছে প্রায় ৫০টি লাশ। ফ্রিজের বাইরে লাশগুলো একটি রুমে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এসব লাশ পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
বর্তমানে ঢামেক মর্গে নবজাতকসহ প্রায় ৫০টি বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। ঈদের আগে পড়ে থাকা ১১টি লাশ নিয়েছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এরপর বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা লাশ নিতে আসেননি। লাশগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
ঢামেক মর্গের ইনচার্জ সিকান্দার আলী জানান, মর্গের দুর্গন্ধে আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। আঞ্জুমান মুফিদুল ঈদে (চাঁন রাতের) আগের দিন থেকে লাশ নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় লাশ জমা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫০ টি লাশ জমা হয়েছে। ফ্রিজে আর জায়গা না থাকায় মেঝে তে রাখা হচ্ছে। এছাড়া লাশের দুর্গন্ধ বাড়ছে।
তিনি আরো জানান, মর্গের ৫টি ফ্রিজের মধ্যে ৩টি ফ্রিজই নষ্ট। যার জন্য লাশগুলো বাহিরে রাখতে হচ্ছে। ফ্রিজ ছাড়াও বছর খানেক হবে এসিগুলোও নষ্ট।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, এসি এবং ফ্রিজ মেরামতের জন্য একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ফ্রিজ ও এসি নষ্ট থাকায় লাশ পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আলামতও।
তিনি আরো বলেন, বেশ কয়েকটি জঙ্গি’র লাশ ও বিদেশি লাশ বেশি সময় ধরে রাখার কারণে আরো একটু স্থান সংকট দেখা দিয়েছে। জঙ্গিদের লাশ গুলো হস্তান্তর এবং বিদেশি লাশ গুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শ করে হস্তান্তর করতে পারলে অনেকটা স্থান সংকট কমবে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এর বিষয়ে তিনি বলেন, কবরস্থানে পানি উঠে যাওয়ায় তারা লাশ নিচ্ছে না। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, পানি সরলে তখন তারা মর্গের লাশ নিয়ে যাবে।
অপরদিকে মর্গ সূত্র জানায়, মর্গের ফ্রিজে চারটি জঙ্গির, চারটি ভারতীয় নাগরিকের, একটি দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকের এবং ফার্মগেটের ক্যাপিটাল মার্কেটের মালিক খোকন নন্দী ওরফে খোকা বাবুর লাশ রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৫টি অজ্ঞাত লাশ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া ২৫টি নবজাতকের লাশ রয়েছে। ফ্রিজের বাইরে এসব লাশ একটি রুমে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় লাশগুলো ফেলে রাখায় তাতে পচন ধরে মর্গের চৌহদ্দিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চার পাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
মর্গে এত লাশ পড়ে থাকার নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের একজন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, হাসপাতাল কিংবা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অজ্ঞাত লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিচয় খুঁজে পেতে লাশ কয়েক দিন মর্গে রাখা হয়। মর্গে রাখার পরও পরিচয় শনাক্ত না হলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ হিসেবে তা দাফন করে। কিন্তু ঈদের পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের লোকজন লাশগুলো না নেয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, বেওয়ারিশ লাশগুলো নিয়ে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু কিছু দিন ধরে বৃষ্টিতে জুরাইন কবরস্থানে পানি জমে আছে। যে কারণে সেখানে লাশ দাফন করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, শনিবার আমরা কবরস্থান এলাকা পরিদর্শন করবো। লাশ দাফনের উপযোগী হলে লাশগুলো নিয়ে দাফন করা হবে।
জুরাইন কবরস্থানের মোহরার মো. শোয়েব হোসাইনের কাছে বেওয়ারিশ লাশ দাফন না করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুরাইন কবরস্থানে মোট ১৭ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ একর ব্যক্তি মালিকানার কবর। এ ছাড়া পাঁচ একর জমিতে অবশিষ্ট লাশ কবর দেয়া হয়। বছরের পর বছর কবর দেয়ায় সেখানে জায়গাও নেই। গেন্ডারিয়া বাজারসংশ্লিষ্ট অবশিষ্ট সাড়ে সাত একর জমিতে বর্তমানে লাশ দাফন করা হয়। সেখানে বেওয়ারিশ লাশও দাফন করা হয়।
তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে এখানে লাশ দাফনের জন্য মাটি খোঁড়া যায় না। একটু মাটি খুঁড়লেই পানি ওঠে। এ কারণে গোরখোদকরাও কবর খুঁড়তে রাজি হন না। ফলে বর্ষার তিন মাস রাজধানীর অন্য কোনো কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করতে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানানো হয়।
তিনি জানান, অতি বৃষ্টির কারণে লাশগুলো পানিতে ভেসে ওঠে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ড) হাসপাতালেও একই অবস্থা বলে শীর্ষ নিউজকে জানিয়েছেন মিডফোর্ড হাসপাতাল মর্গের ইনচার্জ শ্যামল চন্দ্র দাস। তিনি জানান, আমাদের এখানে ফ্রিজ, এসিসহ সব কিছুই ঠিকঠাক আছে। তবে লাশ না নেয়ায় ফ্রিজের সবগুলো সিট ভর্তি হয়ে গেছে। নতুন লাশ আসলে ওখান থেকে বের করে রাখতে হয়। তিনি আরো জানান, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম রমজানের প্রথম সপ্তাহ থেকে লাশ নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত আর লাশ নিতে আসছে না তারা।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ