নিজস্ব প্রতিবেদক:
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে খালে পড়া দুর্ঘটনাকবলিত বাসের যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়ে পুলিশ সদস্য পারভেজ মিয়া এখন এক আলোচিত চরিত্র। তার জন্য গর্বের শেষ নেই পুলিশ বাহিনীর। তারা এই সদস্যের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে আমাদের পারভেজ ঝুঁকি নিয়ে যা করেছে তা হাইওয়ে পুলিশ বিভাগের জন্য সত্যই প্রশংসনীয়। পুরস্কার দিয়ে কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবুও তিনি যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান, এ ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে।’
পারভেজকে এই কাজের স্বীকৃতি কি দেবে রাষ্ট্র?-জানতে চাইলে পুলিশ বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আরও পরে। এটা বলাই যায়, তার ভূমিকা প্রশংসনীয় এবং তার মত কর্মীকে পুলিশ মূল্যায়ন করবে।’
সদস্যদের নানা অপকর্মের কারণে প্রায়ই সমালোচনার শিকার পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অবশ্য নানা সময় বাহিনীর মর্যাদা তুলে ধরেছেন। তার তাদেরকে ভুলে যায়নি বাহিনীও। এদের একজন চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের কনস্টেবল শের আলী।
২০১৬ সালের গত ১১ ডিসেম্বর কক্সবাজারের রামুকে একটি বাস উল্টে পড়ার ঘটনায় এক শিশুকে বাঁচাতে তার আপ্রাণ চেষ্টার ছবি প্রকাশ হয়। শিশুটিকে কোলে নিয়ে তার কান্নার ছবি তখন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পরে শেষ আলীকে গত ২৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনীর দিন তাকে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের পার্শ্ববর্তী ডোবায় পড়ে যায় ঢাকা থেকে মতলবগামী অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে মতলব এক্সপ্রেস বাসটি। উপস্থিত লোকজন যখন দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দি করছিলেন, ঠিক তখন গৌরীপুরে দায়িত্বরত দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার কনস্টেবল পারভেজ মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পঁচা ও গন্ধযুক্ত ময়লা নর্দমার পানিতে তাৎক্ষণিক লাফিয়ে পড়েন। তিনি প্রথমে দ্রুত গাড়ির জানালার গ্লাসগুলো ভেঙে দেন। এতে করে সহজে গাড়ির ভেতরে থাকা যাত্রীরা বেরিয়ে আসছিলেন। এমনকি গাড়ির ভেতর আটকা পড়া অন্তত ২৫ থেকে ২৬ জন যাত্রীর জীবন বাঁচিয়েছেন।
ঢাকাটাইমসের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছে পারভেজ মিয়ার। তিনি বলেছেন, জনগণের দোয়া ও ভালবাসাই তার চাওয়া। তিনি বলেন, ‘নিজের কাছে আজ নিজেকে বড় মনে হয় ২৫ থেকে ২৬ জন যাত্রীর জীবন বাঁচিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করতে পেরেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করছি।’
পারভেজ মিয়ার বাড়ি মুঞ্জীগঞ্জ জেলার গজারিয়া হোসেন্দি গ্রামে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের বড় ছেলে। তারা দুই ভাই এবং দুই বোন। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি চট্টগ্রাম হাইওয়ে দোহাজারী থানায় পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে দাউদকান্দিতে আসেন।
পারভেজ মিয়া বলেন, ‘বাসটি পঁচা ও গন্ধযুক্ত ময়লা নর্দমায় পড়ে যাওয়া পর সবাইকে উদ্ধার করতে পেরেছি সেইটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় অনুভূতি। এর চেয়ে বড় বিষয় হল এমন বিপদের সময় পাবলিক যার যার মত দুর্ঘটনা কবলিত স্থান ও গাড়িকে ছবি ও ভিডিওবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’
সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করে পারভেজ বলেন, ‘দেখলাম কেউ এগিয়ে আসছেন না। তখনই আমি নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই নর্দমায় লাফিয়ে পড়ি। গাড়ির ভেতর আটকা পড়া ২৫ থেকে ২৬ যাত্রীকে সুস্থ অবস্থায় গ্লাস ভেঙে উদ্ধার করি।’
‘উদ্ধারের শেষ পর্যায়ে পাঁচ বছরের একটি শিশু সন্তাকেও পানির নিচ থেকে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করেছি। এরপর ওই নর্দমায় ডুব দিয়ে খুঁজে দেখেছি আর কোনো যাত্রী আছে কি না।’
এই ঘটনার পর পারভেজকে পুরস্কৃত করেছে পুলিশ বিভাগ। তাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে উপহার হিসেবে। আরও ১৫ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন দুই জন। তবে এই টাকা নিয়ে ভাবছেন না পারভেজ। তিনি বলেন, ‘স্যাররা আমাকে সম্মনিত ও পুরস্কৃত করেছেন। এটাই আমার বড় পাওয়া। টাকা পয়সা নয়। ’
পারভেজ বীরত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্থানীরা। পার্শ্ববর্তী পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার বলেন, ‘কনস্টেবল পারভেজের বুদ্ধিবলে রক্ষা পেয়েছে বহু যাত্রীর প্রাণ। আমরা দাবি করি, তার জন্য এখন পুলিশ বাহিনী কিছু করুক।’
দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার এ কর্মতৎপরতায় গর্বিত হাইওয়ে পুলিশ। ডিআইজি আতিকুর রহমান স্যার তার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তার সাহসিকতায় কুমিল্লা রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ ১০ হাজার টাকা, স্থানীয় পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।’
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ